৬ মাসেও পরিষ্কার হয়নি অধিকাংশ ড্রেন, বেড়েছে মশার উপদ্রব

আমার বাসার পাশেই পৌরসভার ড্রেন, বছরখানেক হবে ড্রেনটি পরিষ্কার করে না। মাঝেমধ্যে রাস্তার পাশ দিয়ে কোনোরকম মশার স্প্রে করে চলে যায়। বাড়ির পাশে ড্রেনে জন্ম নেওয়া মশার কামড়ে আমার ছেলে রাতুল (২৩) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। গত তিনদিন ধরে সে ভোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এভাবেই ঢাকা পোস্টের কাছে অভিযোগ করছিলেন ভোলা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়াজিদিয়া মসজিদ সড়কের বাসিন্দা মো. আওলাদ হোসেন। তিনি জানান, হাসপাতালে ভর্তির দুদিন আগে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেয় তার অনার্স পড়ুয়া ছেলের শরীরে।
ভোলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ভোলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৩০ জন। এর বিপরীতে চলতি জুন মাসের প্রথম ১৯ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ জন। অথচ ২০২৪ সালের জুন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র তিনজন।
শহরের কিছু এলাকায় মশক নিধনে নিয়মিত স্প্রে ও ড্রেন পরিষ্কার করা হলেও পৌর এলাকার আওতাধীন শহরের বাইরের এলাকায় ছয় মাসেও একবার মশক নিধনে ওষুধ ছিটানো হয় না। ড্রেনও পরিষ্কার করা হয় না। ফলে সবসময় মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ থাকেন শহরের বাইরের পৌর এলাকার বাসিন্দারা। চলতি বছর বর্ষার শুরুতে মশার উপদ্রব বাড়ায় তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে বহুগুণে
ভোলা পৌরসভা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রথম শ্রেণির পৌরসভাগুলোর মধ্যে এটি একটি। নয়টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই পৌরসভায় কয়েক লাখ মানুষের বসবাস। পৌরসভার জলাবদ্ধতা নিরসনে গত কয়েক বছরে খনন করা হয়েছে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার ড্রেন। এছাড়া পৌরসভার ভেতরে দিয়ে বয়ে গেছে দুই থেকে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আন্ধির খাল, আলীনগর খাল, চরজংলা খাল, বালিয়াকান্দি খাল ও ভোলার খালসহ মোট পাঁচটি খাল। রয়েছে শতাধিক পুকুর। চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে এসব এলাকায় মাত্র চারটি ফগার মেশিন দিয়ে মশক নিধনে স্প্রের মাধ্যমে ওষুধ ছিটানোর কাজ করছে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ।

পৌরসভার আওতাধীন যুগিরঘোল, চরজংলা, উকিলপাড়া, মুসলিম পাড়া, জামিরালতা ও সাগর বেকারি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার ড্রেনগুলো মিলেছে শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলোর সঙ্গে। তবে, দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ ড্রেন পরিষ্কার না করায় অনেকটা ভরাট হয়ে কমেছে পানি নিষ্কাশনের গতি। অন্যদিকে, পৌর এলাকার অধিকাংশ পুকুর ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন
অভিযোগ উঠেছে, শহরের কিছু এলাকায় মশক নিধনে নিয়মিত স্প্রে ও ড্রেন পরিষ্কার করা হলেও পৌর এলাকার আওতাধীন শহরের বাইরের এলাকায় ছয় মাসেও একবার মশক নিধনে ওষুধ ছিটানো হয় না। ড্রেনও পরিষ্কার করা হয় না। ফলে সবসময় মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ থাকেন শহরের বাইরের পৌর এলাকার বাসিন্দারা। চলতি বছর বর্ষার শুরুতে মশার উপদ্রব বাড়ায় তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে বহুগুণে।

পৌরবাসীর ক্ষোভ
ভোলা পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. ফজলু ও শাহে আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নিয়মিত পৌরকর পরিশোধ করি। কিন্তু পৌরসভা থেকে যথাযথ সুবিধা পাই না। সন্ধ্যার পর বাড়িতে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ড্রেন ও আশপাশে জমে থাকা পানির মধ্যে মশা জন্ম নিয়েছে। সেসব মশা কামড় দিলে আক্রান্ত স্থানে প্রচুর চুলকায় ও একপর্যায়ে ফুলে যায়।
মো. বাবু নামের একজন প্রশ্ন তুলে বলেন, কেন আমরা অবহেলিত। মাস তিনেক পার হলেও মশার ওষুধ ছিটাতে দেখি না। তিন মাস আগে পৌরসভা থেকে একবার এসেছিল ওষুধ ছিটাতে। কোনো রকম রাস্তার পাশে ছিটিয়ে চলে যায় তারা।
পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের জামিরালতা এলাকার বাসিন্দা মো. আল আমিন ও মো. মাকসুদ। তারা অভিযোগ করে বলেন, সন্ধ্যার পরে মশার কামড়ে রাস্তাঘাটে থাকাই যায় না। বাড়িতে থাকাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। প্রায় ছয় মাস আগে এখানকার ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে, সর্বশেষ কবে এই এলাকায় মশার ওষুধ ছিটিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ তা আমাদের জানা নেই।

যুগিরঘোল এলাকার বাসিন্দা মো. লিটন ও মুরাদ বলেন, যুগিরঘোল ঈদগাহ জামে মসজিদের পুকুরটি দীর্ঘদিন ধরে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে আছে। প্রচুর মশা, রাতে দৃশ্যমান হয়। আসলে পুকুরটি পরিষ্কারে কাউকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখিনি।
মুসলিম পাড়া বাজার সংলগ্ন পশ্চিম কাঁঠালি এলাকার বাসিন্দা মো. নিজাম বলেন, মাঝেমধ্যে আমরা নিজেরাই ড্রেনের ময়লা সরিয়ে দিই। মশার জ্বালায় মশারি না টানিয়ে ঘুমানো যায় না।
যা বলেছে ভোলা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ
ভোলা পৌরসভার কিছু ড্রেন সরু হয়ে আছে যেগুলো এখনও পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি— জানিয়ে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুব শিগগিরই সেসব ড্রেন পরিষ্কার করা হবে, যাতে মশক নিধন কার্যক্রম শতভাগ সফল হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৌরবাসী যাতে স্বস্তিতে বসবাস করতে পারেন সেজন্য ড্রেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি উন্নত মানের ওষুধ ও উন্নত ফগার মেশিনের মাধ্যমে মশক নিধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে ভোলা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর পরিষ্কারের দায়িত্ব আমাদের না। পুকুরমালিকদের আমরা চিঠি দেব, যাতে তারা নিজ উদ্যোগে সেসব পরিষ্কার করেন। প্রয়োজনে পৌরসভা তাদের সহযোগিতা করবে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আরও গতিশীল করার উদ্যোগ নেবেন বলেও জানান তিনি।
যা বলছেন সিভিল সার্জন
ডেঙ্গু মোকাবিলায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন ভোলার সিভিল সার্জন ডা. মু. মনিরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিজ উদ্যোগে যার যার আঙিনা পরিষ্কার রাখতে হবে। তিনদিনের বেশি বৃষ্টির পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবে না। ভোলায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের রয়েছে।

ডেঙ্গুর সর্বশেষ পরিস্থিতি
গতকাল শনিবার (২৮ জুন) সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ২৬২ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪১ জন আক্রান্ত হয়েছেন বরিশাল বিভাগে। এ সময় ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে নয় হাজার ৪৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের।
এসএসএইচ