মুন্সীগঞ্জের শতবর্ষী হাটে সপ্তাহে বিক্রি হয় ২০ হাজার মণ পাট

মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার দিঘীরপাড় শতবর্ষী পাটের হাট আবারও জমজমাট হয়ে উঠেছে। সোনালী আঁশে ছেয়ে গেছে হাটের প্রতিটি কোণ, নদীর ঘাট থেকে শুরু করে বাজারের ভেতর পর্যন্ত। বাজারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় পাশের পদ্মা নদীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রতি শুক্রবার ও সোমবার বসে পাটের এই ঐতিহ্যবাহী হাট।
শুধু মুন্সীগঞ্জ নয়, আশপাশের শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলার কৃষকরাও পাট নিয়ে আসেন এখানে। প্রতি হাটবারে প্রায় ১০ হাজার মণ পাট বিক্রি হয় এ বাজারে। শুক্রবার ও সোমবার হাটের দিন হওয়ায় এ দুদিনের হিসেবে সপ্তাহে ২০ হাজার মণ পাট বিক্রি হয় বলে জানান স্থানীয়রা।
দিঘীরপাড় বাজার কমিটির সেক্রেটারি মফিজল মোল্লা বলেন, এই হাটে শুধু মুন্সীগঞ্জ নয়, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, চাঁদপুর ও কুমিল্লা জেলার কৃষকরাও পাট নিয়ে আসেন। এখান থেকে পাট কিনে পাইকাররা নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে থাকেন। এ বছর পাটের দামও ভালো।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষকেরা ভ্যান, অটোরিকশা ও নৌকায় পাট বোঝাই করে ভিড় জমান এই শতবর্ষী হাটে। কোনো কোনো কৃষক মাথায় করেও পাট নিয়ে আসেন এ হাটে। বিশেষ করে নদী ঘেঁষা হওয়ায় এখানে ট্রলার বা নৌকায় করেই আসে অধিকাংশ পাট। ছোট ট্রলারে করে কৃষকেরা পাট নিয়ে আসেন আর নদীতে অপেক্ষা করা বড় ট্রলারগুলোতে সেই পাট কিনে নেন পাইকাররা। ফলে সেখানে ট্রলারেই চলে দরদাম লেনদেন।
শুক্রবার ও সোমবার হাটের দিনগুলোতে পদ্মা নদীর তীর থেকে নদীর গভীর অংশ পর্যন্ত পাইকারদের হাঁকডাক, দরদামের কথাবার্তা সব মিলিয়ে এলাকা হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। দিঘীরপাড় হাটের ইতিহাস ২০০ বছরেরও পুরোনো। ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসা এই হাট এখনও দেশের অন্যতম বৃহৎ পাটের আড়ত হিসেবে বিবেচিত হয়। সপ্তাহে দুদিন সোমবার ও শুক্রবার ভোর থেকে শুরু হয় বেচাকেনা।
এই হাটে আশপাশের জেলার বিপুলসংখ্যক কৃষক পাট নিয়ে আসেন বলেই প্রতিবারের হাটে বেচাকেনার পরিমাণ হয় বিপুল। ট্রলারের মাধ্যমেই পাট ওঠানো-নামানোর কাজ চলে। এই ভিন্নধর্মী বেচাকেনা পদ্ধতি পাটকেন্দ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।
কৃষকদের মতে, কয়েক বছর ধরে পাটের দাম ও চাহিদা কিছুটা কম থাকলেও এ বছর পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো। উৎপাদন খরচ যেখানে প্রতি মণে ২,০০০ থেকে ২,২০০ টাকা, সেখানে বিক্রি হচ্ছে ৩,২০০ থেকে ৩,৫০০ টাকায়। ফলে প্রতি মণে কৃষকের লাভ হচ্ছে গড়ে ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা।
শরীয়তপুরের কৃষক আয়জল মিয়া বলেন, আমরা প্রতিবছরই এই হাটে পাট নিয়ে আসি। আমার বাবা-দাদারাও আসতেন। এ বছর দাম ভালো, তাই লাভও হচ্ছে।
আরও পড়ুন
কৃষক জুলহাস দেওয়ান বলেন, এ বছর ৮০ শতাংশ জমিতে পাট চাষ করেছি। খরচ হয়েছে প্রায় ৬ হাজার টাকা। নিজেরাই সব কাজ করেছি। পাট বিক্রি করেছি প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার টাকার মতো। লাভ দেখে মনটা ভরে গেছে।
রহিম বেপারী নামে একজন বলেন, এক একর জমিতে পাট করেছি। খরচ হয়েছে ১৫–১৬ হাজার টাকা। বিক্রি করেছি প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। এখনো কিছু পাট আছে। এভাবে দাম থাকলে আগামীতে আরও বেশি জমিতে পাট চাষ করব।
আব্বাস আলী নামের আরেক কৃষক বলেন, এমন দাম যদি থাকে, তাহলে কৃষকেরা আবারও পাট চাষে আগ্রহী হবে। হারিয়ে যাওয়া পাটের ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে।
পাট ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বলেন, দিঘীরপাড় হাটের সুনাম অনেক পুরোনো। প্রতি হাটে কয়েক হাজার মণ পাট কেনাবেচা হয়। কৃষক যেমন খুশি, ব্যবসায়ীরাও খুশি। এ বছর দামে যেমন স্থিতিশীলতা এসেছে, তাতে সবাই লাভবান হচ্ছে। ট্রলারে নদীতেই অধিকাংশ কেনাবেচা সম্পন্ন হয়। পাইকাররা দূর-দূরান্ত থেকে এখানে আসেন। ফলে এই হাট শুধু স্থানীয় অর্থনীতিই নয়, বৃহত্তর অঞ্চলের কৃষি-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ বছর মুন্সীগঞ্জে ২,৮০০ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়েছে। যদিও গত বছরের তুলনায় প্রায় ৪০০ হেক্টর কম জমিতে আবাদ হয়েছে, তবে উৎপাদন ভালো হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
শুধু দিঘীরপাড় হাটেই এ মৌসুমে আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ হাজার মণ পাট কেনাবেচা হতে পারে। এখানকার পাট সরবরাহ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলার কারখানায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খুরশীদ আলম বলেন, এ বছর পাট উৎপাদন ভালো হয়েছে। কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। সরকারও পাটের ব্যবহার বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। যেমন চটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এতে বাজারে চাহিদা বাড়বে এবং দামও স্থিতিশীল থাকবে।
শামীম/এআরবি