অজপাড়াগাঁয়ের বিদ্যালয় বদলে দিলেন শিক্ষক শহিদুল

দূর থেকে দেখে শিশু পার্ক কিংবা বিনোদনকেন্দ্র মনে হলেও এটি অজপাড়া গাঁয়ের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যে বিদ্যালয়টি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে। আর এই কৃতিত্ব অর্জনের পেছনের মূল কারিগর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো.শহিদুল ইসলাম (৫৩)।
বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের স্বাবলম্বী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ছিলো অবহেলিত। শহিদুল ইসলাম এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কয়েক বছরের মধ্যেই বদলে গেছে বিদ্যালয়ের পুরো চিত্র। এখন বিদ্যালয়ের পাসের হার শতভাগ।
শিক্ষক শহিদুল নিজের কাজের জন্য ২০১৯ সালে একবার দেশসেরা প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। সৎ ও আদর্শবান শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে নিজ উদ্যোগে স্কুলে ‘সততা স্টোর’ চালু ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে ‘বন্ধু টিম’ এর মতো ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে তিনি রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন দেশব্যাপী। বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের যেন পরম মমতায় আগলে রেখেছেন তিনি।
শহিদুল ইসলামের বাড়ি বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে বাড়াদি গ্রামে। সংসারে তার মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে ওয়ালিদ হাসান (২২) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়েন। ছোট ছেলে খালিদ হাসান স্থানীয় বহরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
জানা গেছে, বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের বাড়াদি গ্রামের ১৯৬৮ সালে ৩৩ শতাংশ জমির ওপর একটি টিনের ছাপরা ঘরে স্বাবলম্বী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০ জন শিক্ষার্থী ও চারজন শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয়টি তখন চালু হয়। কিন্তু ফলাফল তেমন ভালো হতো না।১৯৮৪ সালে জাতীয়করণের পরও পিছিয়েই ছিল বিদ্যালয়টি।
২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে স্নাতকোত্তর করা শহিদুল ইসলাম। তখন শিক্ষার্থী ছিল ১২৫ জন। যোগদানের পর পড়াশোনার দুর্দশা দেখে হতাশ হন। কিন্তু তিনি দমে জাননি। বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো করার জন্য ও বিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন।
সরকারি অনুদানের অর্থের অভাবে উন্নয়নমূলক কাজ আটকে যায়। শহিদুল নিজের সম্পত্তি বেচে, বাড়ির গাছ বেঁচে, ঋণ নিয়ে ও বেতনের সিংহভাগ টাকা দিয়ে সেই কাজ চালিয়ে যান। এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত ভাবে সাড়ে ১৪ লাখ টাকা খরচ করেছেন স্কুলের পেছনে। ধীরে ধীরে পড়াশোনার মান বাড়তে থাকেন স্কুলের। ২০০৫ সালে বিদ্যালয়টি উপজেলায় সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
২০০৬, ২০১২ ও ২০১৬ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন শহিদুল। ২০১৯ সালে ঢাকা বিভাগে ও সারা দেশে সেরা প্রধান শিক্ষক হন তিনি। তার ঐকান্তিক চেষ্টায় ২০১৭, ২০২২ ও ২০২৪ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয় স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০২৪ সালে ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় এবং প্রাথমিক শিক্ষা পদকের শ্রেষ্ঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে বিদ্যালয়টি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। এ বছর শিক্ষক শহিদুল রাজবাড়ীর শ্রেষ্ঠ গুণী শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন
সততা স্টোর
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র শিক্ষা নয়, সৎ চরিত্র, আদর্শ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষক শহিদুল ইসলাম ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ে ‘সততা স্টোর’ নামে একটি বিক্রেতা বিহীন দোকান চালু করেন। বিদ্যালয়ের একটি স্থানে শিক্ষা উপকরণ ও বিভিন্ন খাবারের আইটেম রাখা হয়। বিভিন্ন পণ্যের গায়ে দাম লেখা থাকে। আর শিক্ষার্থীরা এসে দাম পরিশোধ করে পণ্য নিয়ে যেত। এটি বাংলাদেশের মধ্যে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সেসময়।শিক্ষার্থীরা সততার পরিচয় দিয়ে বিক্রেতা বিহীন দোকান থেকে পণ্য ক্রয় করে থাকে।
বন্ধু টিম
স্বাবলম্বী স্কুলে তিনটি গ্রামের ৪৮১ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। গ্রামগুলোকে কয়েকটি পাড়ায় বিভক্ত করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ২০২৪ সালে প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম ‘বন্ধু টিম’ গঠন করেন। বন্ধু টিমের সদস্যরা প্রতিদিন একসঙ্গে বিদ্যালয়ে আসে। একত্রেই আবার ফেরে। বন্ধুদের পড়াশোনায় একে অন্যকে সহায়তা করে। প্রত্যেক দলে একজন করে দলনেতা রয়েছে। দলের কেউ বিদ্যালয়ে আসতে না পারলে দলনেতা শিক্ষকদের কাছে জানায়। প্রয়োজনে দলের সদস্যরা কিংবা শিক্ষক নিজে গিয়ে শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন বা খোঁজখবর নেন।
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানো, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে, নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে, সহযোগিতার মনোভাব তৈরিতে বন্ধু টিম বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এই উদ্ভাবনের জন্য স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষক শহিদুলকে সম্মাননা জানানো হয়। গত বছরের ২৪ অক্টোবর নায়েম (ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট) ও ইউনেসকো যৌথভাবে এই সম্মাননা দেয় তাকে।

এভাবেই বালিয়াকান্দির স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে দেশসেরা পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। তিনি প্রমাণ করেছেন— একজন সৎ, আদর্শবান ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক চাইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যেমন বদলে দিতে পারেন, তেমনি বদলে দিতে পারেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনও।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলে, প্রধান শিক্ষক শহিদুল স্যার আমাদের স্কুলটিকে বদলে দিয়েছেন। তিনি নিজ হাতে পরম যত্নে বিদ্যালয়টিকে সাজিয়েছেন। তার কারণে আমরা কখনো স্কুল বাদ দেই না। বিদ্যালয়টি আমাদের কাছে অনেক প্রিয়। এখানে খেলাধুলার অনেক সামগ্রী রয়েছে।বিনোদনের অনেক ব্যবস্থা রয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বহরপুর ডিগ্রি কলেজর এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাকিল শেখ বলেন, স্বাবলম্বী স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি সত্যিই গর্বিত এবং এই স্কুলে পড়তে পেরে আমি আনন্দিত। প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলামকে পেয়ে আমরা আনন্দিত। শহিদুল স্যারের মতন মহৎ ব্যক্তির কারণে এই স্কুলটা দেশ সেরা স্কুলের স্বীকৃতি পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাঠদানে তিনি অত্যন্ত যত্নবান।
স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি নিজে কখনো বড় হতে চাইনি। আমি এই বিদ্যালয়কে ভালোবেসেছি, শিক্ষার্থীদের ভালোবেসেছি। তার জন্য সৃষ্টিকর্তা আমাকে ২০১৯ সালে সারা বাংলাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নে আমরা বিদ্যালয় ছুটির পরে বিশেষ ক্লাস, ছুটির দিনে ‘ছুটির ট্রেন’ নামে একটি বিশেষ ক্লাস এবং প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য নৈশকালীন ক্লাস নিয়ে থাকি। যেগুলো সম্পূর্ণ অবৈতনিক। এছাড়াও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আমি কাজ করে থাকি।
দেশসেরা শিক্ষক হবার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশসেরা হবার অনুভূতিটা ভাষায় বলে প্রকাশ করবার মতো নয়। আমি কখনো ভাবতেই পারিনি এই নিভৃত পল্লী থেকে দেশসেরা শিক্ষক নির্বাচিত হব। আমি খুবই গর্বিত ও পুলকিত আমাকে এমন একটি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
শহিদুল ইসলাম বলেন, আমার আজীবনে উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যালয়টিকে আদর্শ বিদ্যালয়ের রূপ দেব। আমার সকল শিক্ষকবৃন্দ, এসএমসি সদস্যবৃন্দ ও এলাকাবাসী মিলে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছি বিদ্যালয়টিকে আদর্শ বিদ্যালয় এবং শিশুদের জন্য স্বর্গ স্বরূপ একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। সেই লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পথ চলার পুরস্কার হিসেবে বিদ্যালয়টি ঢাকা বিভাগের মধ্যে প্রথম ও জাতীয় ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। নিভৃত পল্লীর একটি স্কুলের এই অর্জন আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের।
তিনি বলেন, আমি চেষ্টা করেছিলাম বিদ্যালয়টিকে দেশের মধ্যে একটু আদর্শ বিদ্যালয়ে রুপ দিতে এবং এই বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি শিশুকে আমি আদর্শ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এই সেবা দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত শ্রম ও মেধা দেওয়ার বিকল্প নেই। যে কারণে আমি একদিনও ছুটি নেইনি গত ১৫ বছরে।
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে। এতে শিক্ষকদের প্রত্যাশা কতটুক পূরণ হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে শহিদুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকতা একটা পেশা নয়, এটা সেবা। শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের প্রত্যাশা পূরণ হবে বলে আমি আশা করি। আমরা আসলে কষ্ট পাই যখন দেখি এদেশে শিক্ষকদের এখনো বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে বা চাহিদা মেটাতে রাজপথে নামতে হয়। তবে আমি প্রত্যাশা করি শিক্ষক দিবসে আমাদের শিক্ষকদের জন্য এটা হবে একটা অঙ্গীকার যাতে সকল শিক্ষক মানসম্মতভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। আমাদের সরকার যেন সে দিকে দৃষ্টি দেয়- এটাই আমার প্রত্যাশা।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা জানান, এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক। শিক্ষকতায় পেশার শুরুতেই দেশসেরা এমন একজন শিক্ষকের সহকর্মী হিসেবে কাজ করতে পেরে তারাও গর্বিত।
প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম সম্পর্কে কয়েকজন অভিভাবক বলেন, শিক্ষক শহিদুল ইসলাম পরম যত্নে বিদ্যালয়টিকে আগলে রেখেছেন। তিনি একজন আদর্শবান শিক্ষক।
শিক্ষক শহিদুল ইসলামের স্ত্রী কাকলী ইসলাম বলেন, পরিবারের থেকে স্কুলকে বেশি সময় দেন তিনি। সকাল ৮টা থেকে প্রায় দিনই অনেক রাত পর্যন্ত উনি স্কুলেই থাকেন। বিষয়টি আগে আমার কাছে খারাপ লাগলেও এখন ভালো লাগে। যার ফলস্বরূপ তিনি দেশসেরা শিক্ষক হয়েছিলেন এবং স্কুলটাকে দেশসেরা করতে ভূমিকা রাখছেন।
রাজবাড়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. তবিবুর রহমান বলেন, শিক্ষক শহিদুল ইসলাম পরম যত্নে স্কুলটাকে নিজ হাতে সাজিয়েছেন। তিনি স্কুলে সততা স্টোর ও বন্ধু টিমসহ ব্যতিক্রমী কিছু কাজ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। তার কারণেই শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় মুখি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার হার ওই স্কুলে শূন্য। তার কারণেই জাতীয় পর্যায়ে এই স্কুলটা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্কুলের উন্নয়নে যে ভূমিকা রাখছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, স্বাবলম্বী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্কুলের চিত্র পাল্টে গেছে। বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এবং স্কুলের ডিসিপ্লিন অসাধারণ। সারা বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যালয়টি অনুকরণীয়। আমি মনে করি তিনি একজন আদর্শবান শিক্ষক। শিক্ষক দিবসে তার প্রতি রইলো শ্রদ্ধা।
আরএআর