চাকরি ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন স্কুল, বদলে দেন কয়েক গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা

১৯৯৫ সালের দিকে দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম। ভালো বেতনে চাকরি করলেও তার ভাবনায় ছিল নিজ এলাকার পিছিয়ে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থা। একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন। নিজ উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে ৪৮ শতক জমি ওপর নির্মাণ করেন চরমোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয় নামের এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এ সময় তাকে পরিবারের পাশাপাশি সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও। পরের বছরের জানুয়ারিতে ষষ্ট থেকে অষ্টম শ্রেণিতে মাত্র ৯৫ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয় বিদ্যালয়টির পাঠদান কার্যক্রম। প্রথম ২৮ মাস বিনা বেতনে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করেন মো. রফিকুল ইসলাম। বর্তমানে স্কুলটি সোয়া চার বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। স্কুলটির বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৭৭৫ জন, শিক্ষক-শিক্ষিকা ১৭ জন ও কর্মচারী আছেন সাতজন।
এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মহানন্দা নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত চরমহনপুর গ্রাম। আগে এই এলাকাটি মোহনপুর নামে পরিচিত ছিলে। নদী ভাঙনের পরে এই এলাকায় চর জেগে উঠে। চর এলাকায় লোকজনের বসবাস শুরু হলে এলাকাটির নাম হয় চরমোহনপুর। চরমোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার আগে এই এলাকায় তেমন ভালো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। এর ফলে চরমোহনপুর, চকপাড়া, লাহাপাড়া, মোহনপুর ও টিকরামপুরের দক্ষিণ মাথা এলাকার বাসিন্দারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে শিক্ষা জীবনে পিছিয়ে পড়তো। ফলে মো. রফিকুল ইসলামের উদ্যোগে চরমহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে এলাকার শিক্ষার মান অনেক এগিয়ে যায়। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ে যাওয়ার হার অনেকটায় কমে যায়।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মো. রফিকুল ইসলাম প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া, তিনি ১৯৮৯ ও ৯১ সালে শংকবাটী হেফজুল উলুম এফ.কে কামিল মাদ্রাসা থেকে এসএসসি ও এইএসসি পাশ করেন। ১৯৯৩ সালে নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি এবং ১৯৯৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ইসলমিক স্টাডিজে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছেন এবং ছোট মেয়ে ২০২৬ সালের এসএসসি পরিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থী মো. জামাল উদ্দিন বলেন, রফিকুল ইসলাম স্যার একজন সাধাসিধে ও ভালো মনের মানুষ। তিনি নিজ উদ্যোগে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সুনামের সঙ্গে পরিচালনা করে আসছেন। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার ফলে আমাদের এলাকার শিক্ষার মান অনেক উন্নত হয়েছে। জেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ওনার অনেক কৃতি শিক্ষার্থী ছড়িয়ে পড়েছেন এবং তারা দেশের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। আমি রফিকুল ইসলাম স্যারের জন্য মন থেকে দোয়া করি এবং তিনি মানবসেবাই আরও কাজ করতে পারেন এই প্রত্যাশা করি।

বিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থী ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের কর্মকর্তা সালাউদ্দিন বলেন, রফিকুল স্যার একজন অসাধারণ ও অমায়িক মানুষ। তিনি প্রতিটা ছাত্রকে নিজের সন্তানের মতো করে দেখতেন এবং সবার খোঁজ খবর রাখতেন। বিদ্যালয়টির শিক্ষার মান উন্নয়নে তিনি বেশ আন্তরিক ছিলেন এবং অনেক পরিশ্রম করতেন।
আরেক শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার কামাল উদ্দিন বলেন, রফিকুল ইসলাম স্যার অমায়িক মানুষ। এলাকাতে তিনি সুপরিচিত এবং তার সুনাম রয়েছে। তিনি আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। গরিব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে প্রাইভেট ও বই দিয়েও সহোযোগিতা করতেন। আমি স্যারের সব সময় মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
অত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. জহরুল ইসলাম বলেন, চরমোহনপুর এলাকার গুটি কয়েকজন লোকজন নিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করে তিনি স্কুলটি গড়ে তোলেন। এলাকাটি বন্যাকবলিত হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিষ্ঠানটির ক্লাস রুমগুলো বারবার নষ্ট হয়ে যেত। তবে বারবার তিনি ক্লাসরুমগুলোকে মেরামত করতেন, কখনো থেমে যাননি। তিনি সবসময় যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতেন এবং বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত করার ক্ষেত্রেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। এ ছাড়া, প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার জন্য সব শিক্ষকদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মধ্যে একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত করেছেন। এজন্য তিনি অত্র এলাকার মানুষজন, প্রতিষ্ঠানটির অনান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। রফিকুল ইসলাম স্যারের পরামর্শ ও কথা সবাই এক বাক্যে মেনে চলেন।

তিনি আরও বলেন, রফিকুল স্যারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও কর্মপরিকল্পনায় এবং অনান্য শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের সহোযেগিতায় জেলায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান অনেক ভালো। এই বিদ্যালয়ের অনেক কৃতি শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, বিজিবি, শিক্ষক, ডাক্তার, সেনাবাহিনী ও ব্যাংকসহ বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত রয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে রফিকুল স্যার একজন দায়িত্বশীল, কর্মঠ ও প্রতিষ্ঠান বান্ধব মানুষ। এজন্য রফিকুল স্যার আমারও প্রিয় শিক্ষক ও সহকর্মী।
চরমোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, পড়াশোনা শেষ করার পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করি। কিন্তু আমার গ্রামের শিক্ষার মান খুবই নাজুক ছিল। আমাদের গ্রামে একটি মাত্র প্রাইমারি স্কুল ছিল এবং গ্রাম থেকে অনেক দূরে উচ্চ বিদ্যালয় ছিল। সে সময়ে গ্রামের ছেলেরা দূরের স্কুলে পড়তে যেতে পারলেও গ্রামের মেয়েরা স্কুল দূরে হওয়ার কারণে পড়তে যেতে পারতো না। এর ফলে অনেক মেয়ে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়তো এবং অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যেত। সেই থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমি গ্রামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবো। তখন এই বিষয়ে পরিবারকে জানাই এবং পরিবারও আমাকে উৎসাহ দেয়। পরে চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে আসি এবং এলাকার মুরুব্বিদের সঙ্গে নিয়ে চরমোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই স্কুলটির শিক্ষার মান ধরে রাখার চেষ্টা করি। বর্তমানে সাইন্স ও আর্টস বিভাগ চালু থাকার পাশাপাশি ভোকেশনাল শিক্ষা ব্যাবস্থাও চালু আছে আমারদের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
তিনি আরও বলেন, বলতে পারেন আমি এই জীবনে সফল ব্যাক্তি। একটি ভালো মানের উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। এই বিদ্যালয় থেকে অনেক ছেলে মেয়ে ভালো ভালো জায়গায় চাকরি করছে, আবার অনেকে অন্য পেশায় ভালোভাবে জীবনযাপন করছে। আমার ছাত্র-ছাত্রীদের কৃতিত্ব দেখে শিক্ষক হিসেবে আনন্দ পাই এবং সমাজের অনেকে আমাকে শ্রদ্ধা করে যা আমাকে আবেগাপ্লুত করে। তাই আমার জীবনে অপ্রাপ্তির কিছু নেই। বাকি জীবন এই প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে নিতে আরও কাজ করে যেতে চাই।
এএমকে