সাত বছর ধরে পাঠদান না করিয়েও নিয়মিত বেতন তোলেন শিক্ষক

নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কানুচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ সাত বছর ধরে নিজেকে ‘অসুস্থ’ দেখিয়ে পাঠদান থেকে বিরত আছেন সহকারী শিক্ষক মো. মজিবুল হক ভূঁইয়া। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকলেও নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলছেন।
স্থানীয় অভিভাবকরা বলছেন, সহকারী শিক্ষক মজিবুল হকের পরিবর্তে খাদিজা নামে তার একজন সাবেক ছাত্রী পাঠদান করান। খাদিজার শিক্ষাকতার প্রশিক্ষণ না থাকায় শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালে মো. মজিবুল হক ভূঁইয়া কানুচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ সময় তিনি স্বাভাবিকভাবে পাঠদান চালিয়ে গেলেও প্রায় সাত বছর আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর থেকে শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতার কারণ দেখিয়ে তিনি আর পাঠদান করেন না।
তবে পাঠদান বন্ধ থাকলেও নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলছেন তিনি। বর্তমানে তার মাসিক বেতন প্রায় ৩৫ হাজার টাকা হলেও শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে প্রক্সি হিসেবে খাদিজাকে মাত্র ৫-৬ হাজার টাকা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিভাবকদের অভিযোগ, এ বিষয়ে এলাকাবাসী বহুবার শিক্ষা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, একজন অযোগ্য ও প্রশিক্ষণহীন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে পাঠদান কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, খাদিজা আক্তার শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের আসনে বসে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন। প্রথমে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, কোচিং ক্লাস নিচ্ছেন। তবে পরে শিক্ষক কমনরুমে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে। এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন, অসুস্থ শিক্ষক মজিবুল হক ভূঁইয়ার প্রক্সি হিসেবে তিনি পাঠদান করে আসছেন।
মো. রেদোয়ান নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পাঠদান না করিয়েও বেতন-ভাতা নিচ্ছেন শিক্ষক মজিবুল হক। সেই বেতনের ভাগ অনেক ওপর পর্যন্ত যায়। তাই কেউ মুখ খুলছেন না। তার পদে সরকারিভাবে কোনো শিক্ষক না নিতে পারায় অন্যান্য শিক্ষকরাও পড়াশোনার পরিবেশ পাচ্ছেন না। বিদ্যালয়টিতে কার্যত অচলাবস্থা বিরাজ করছে। তিনি যদি অবসরে যান তাহলে এখানে শিক্ষক পদায়ন হলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।
বিদ্যালয়ের আরেক সহকারী শিক্ষক মো. মাজহারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, খাদিজা সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত না। প্রক্সি হিসেবে ক্লাস নিচ্ছেন। তার পড়ানোর ধরন ঠিক নেই। সে আসলে কোনো প্রশিক্ষণ পায়নি। নিজের মতো করে পড়ান। এতে করে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সুলতানা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২০২৩ সালে এই বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসি। তখন থেকেই দেখছি খাদিজা ক্লাস নিচ্ছে। মজিবুল হক স্যার প্রায় সাত বছর ধরে ক্লাস নিতে অক্ষম। তবে মাঝেমধ্যে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে এক-দুটি ক্লাস নেন। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, কিন্তু এখনো কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না তা আমার জানা নেই।
অভিযোগের বিষয়ে খাদিজা আক্তার কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি। তবে একপর্যায়ে বিষয়টি স্বীকার করে নেন মো. মজিবুল হক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমিও ক্লাস নেই আবার খাদিজাও ক্লাস নেয়। খাদিজাকে আমার পক্ষ থেকে ৬ হাজার টাকা বেতন দেই। আমাকে থানা শিক্ষা অফিসার বলেছেন গেস্ট শিক্ষক না রাখার জন্য। আমার স্ত্রী আমার অসুস্থতা ও অক্ষমতার কথা জানালে থানা শিক্ষা অফিসার রাখার অনুমতি দেন।
চলতি বছর ১৫ জানুয়ারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার আনোয়ার পারভেজ শিক্ষক মজিবুল হক ভূঁইয়ার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, মজিবুল হক ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। তিনি লিখতে অক্ষম। তার পক্ষে খাদিজা আক্তার পাঠদান করান।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ইসরাত নাসিমা হাবীব ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা উপজেলা শিক্ষা অফিসার থেকে একটি প্রতিবেদন পেয়েছি। সেখানে মো. মজিবুল হক ভূঁইয়াকে ক্লাস নিতে অক্ষম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আমরা বিষয়টি সিভিল সার্জন অফিস বরাবর একটি আবেদন দিয়েছি যে, মজিবুল হক মানসিক ও শারীরিকভাবে আনফিট কিনা জানার জন্য। সেটি পেলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। পাশাপাশি বহিরাগত কেউ ক্লাস নেওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা অফিসার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
হাসিব আল আমিন/আরকে