শুধু বইয়ের পাঠ নয়, জীবনের পাঠও শেখাতেন তিনি

“শুধু পাঠ্যবই নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রে শিক্ষা হিসেবে গণ্য করতে হবে, জীবনে সৎ হতে হবে, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে।"—এমন সব নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতেন প্রয়াত শিক্ষক আব্দুল জলিল। হাজারো শিক্ষার্থীর শিক্ষাগুরু গত আগস্টে মৃত্যুবরণ করেন। তার শোকে এখনও কাতর শিক্ষার্থীরা।
প্রয়াত শিক্ষক আব্দুল জলিল শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর ইউনিয়নের তারাশিমুলিয়া গ্রামের মো. আলিমুদ্দিন সরদারের ছেলে। তিনি ১৯৪৬ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ ৪২ বছরের শিক্ষকতা জীবনের পর ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আদর্শবান ও ত্যাগী। পরিবারের চেয়ে তিনি স্কুলকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে তদারকি করতে সকাল ৭টায় ঘর থেকে স্কুলে চলে যেতেন আর সন্ধ্যার সময় বাড়িতে আসতেন। এভাবে সারাদিন স্কুলেই কাটিয়ে দিতেন।
জানা যায়, আব্দুল জলিল ১৯৬৬ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কনেশ্বর শ্যামা চরণ এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনে। এরপর ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রায় দীর্ঘ ৪২ বছর শিক্ষকতা শেষে ২০০৬ সালে অবসর নেন।
আরও পড়ুন
আব্দুল জলিলের শিক্ষক জীবন ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে পাঠদান করাতেন। তার শিক্ষার মূলমন্ত্র ছিল—শিক্ষা শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তিনি শিক্ষার্থীদের শুদ্ধতা, পরিশ্রম, সততা এবং ভালোবাসা দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতেন। শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশা করেন, মহান শিক্ষক আব্দুল জলিলের মৃত্যু হলেও তার আদর্শ ও শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের নিকট পৌঁছে যাবে।
আব্দুল জলিলের ছাত্র একটি বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. এনামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, জলিল স্যার আমাদেরকে বহুবিধ শিক্ষা দিয়েছেন, নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। স্যার এমন চৌকস ছিলেন যে সব সাবজেক্ট পড়াতেন। গণিত ও ইংরেজিতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। আমার এখনও মনে পড়ে, স্যার বলতেন, “আজকে আমি যাদের শাসন করছি, তোমরা একদিন বড় হবা।” তারই ধারাবাহিকতায় আজকে আমি একটি বিদ্যালয়ে কর্মরত।
তিনি আরও বলেন, স্যারের আরেকটা স্মৃতি আমার খুব মনে পড়ে, কোনো শিক্ষার্থী যদি পড়া না পারতো, তখন আমাদের স্কুলের একজন দপ্তরি ছিলেন, সুরেন বাবু, তাকে বলতেন, “এই সুরেন আমার জোড়া বেতটা নিয়ে আয় তো। পরে সেই বেত দিয়ে স্যার আমাদের প্রহার করতেন। তখন খুব কষ্ট হলেও এখন বুঝতে পারছি স্যারের সেই প্রহারের কারণেই আজকে তার অনেক ছাত্র রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত।
আরেক ছাত্র মো. লিমন সিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্যার আমাদের শুধু বইয়ের পাঠ শিখাতেন না, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পাঠও দিয়েছেন। তার শিক্ষা আমাদের জীবনে আজও কাজ করছে। তার অবদান কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
আব্দুল জলিলের ছেলে মো. মোস্তফা কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা টানা ৪২ বছর কনেশ্বর স্কুলের সহকারী শিক্ষক এবং ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন। তিনি এমন একজন আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন যে, তার ছাত্রদের টানে সকাল ৭টায় ঘর থেকে স্কুলে চলে যেতেন আর সন্ধ্যার সময় বাড়িতে আসতেন। সংসারের প্রতি তার কোনো টান ছিল না। আমার বাবা শিক্ষাদানের জন্য তার জীবনের সবটা উজাড় করে দিয়েছিলেন। এখন তার ছাত্ররা ডিসি, এসপি, সচিবসহ বড় বড় সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা। আমি জলিল স্যারের সন্তান হিসেবে গর্বিত।
আব্দুল জলিলের পুত্রবধূ উম্মে হানি (শিউলি) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার শ্বশুর ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। তিনি স্কুলে রাগী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হলেও ঘরে ছিলেন সহজ-সরল ঠাণ্ডা একজন বাবা। তার মধ্যে আমি কখনও রাগ-অহংকার দেখিনি।
গোসাইরহাট উপজেলার ইদিলপুর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ এমদাদ হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কনেশ্বর শ্যামা চরণ এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনে ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। মরহুম আব্দুল জলিল স্যার আমার সহকর্মী ছিলেন। আমার কর্মজীবনে তার সঙ্গে প্রায় ১৮ বছর চাকরি করেছি। আমি তার চালচলন, আচার-আচরণে অত্যন্ত মাধুর্যপূর্ণ ব্যবহার পেয়েছি এবং তিনি সহযোগিতা পূর্ণ ছিলেন। যখনই কোনো সমস্যায় পড়তাম, উনি সুন্দরভাবে সমাধান করে দিতেন। আশা করি, আল্লাহ তাকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করবেন।
এএমকে