চিকিৎসক সংকটে খুঁড়িয়ে চলছে রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল

রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটে ব্যহত হচ্ছে সেবা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। উন্নত চিকিৎসা নিতে যেতে হচ্ছে ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও ঢাকায়। এ ছাড়া, হাসপাতালটিতে রয়েছে শয্যা সংকট। এ অবস্থায় চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
জেলার প্রায় ১২ লাখ জনসংখ্যার একমাত্র এই আধুনিক হাসপাতালে নেই সিনিয়র মেডিসিন, শিশু, সার্জারি, কার্ডিওলজী, গাইনী, চর্ম ও যৌন, ফরেনসিক মেডিসিন, ইএনটি, এনেস্থিসিয়া ও জুনিয়র চক্ষুর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। যার ফলে সঠিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না জেলাবাসী। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের।
এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটের কথা জানিয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব বরাবর একটি লিখিত আবেদন দিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান। পত্রে তিনি রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের জন্য ১০ জন সিনিয়র কনসালটেন্ট ও ১১ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট পদায়নের জন্য আবেদন করেন।
সরেজমিনে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেকটি ওয়ার্ডেই ভর্তি রোগীর চাপ বেশি। ডায়রিয়া, সার্জারি, শিশু, গাইনি, মেডিসিন ওয়ার্ডে বরাদ্দকৃত বেডের চেয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। বহিঃর্বিভাগেও রয়েছে রোগীর বাড়তি চাপ। ঠান্ডা, কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিতে রোগীরা এসেছেন সেবা নিতে। রোগীর চাপ থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ নভেম্বর দুপুর ১২টা থেকে ২৫ নভেম্বর দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সদর হাসপাতালে ১০০ শয্যার বিপরীতে মোট ১৮৯ জন ভর্তি রোগী ছিলেন।
১০০ শয্যার এ হাসপাতালের চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৪৩টি। এর মধ্যে কার্ডিওলজি, গাইনি, ফরেনসিক, শিশু, চর্ম ও যৌন, রেডিওলজি, মেডিসিন, প্যাথলজি, সার্জারিসহ ২৩টি পদ শূন্য। এর মধ্যে কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি), কনসালটেন্ট (মেডিসিন), কনসালটেন্ট (চক্ষু) মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক না থাকায় চিকিৎসাসেবা ব্যহত হচ্ছে।
এ ছাড়া, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির ৭৪টি পদের মধ্যে ৩৩টি পদ শূন্য রয়েছে। শূন্য পদ পূরণের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভাগীয় অফিসে পত্র প্রেরণ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ২০০৮ সালে হাসপাতালটির নামকরণ ও আধুনিকায়ন হলেও গত ১৭ বছরে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া লাগেনি হাসপাতালটিতে।
রাজবাড়ী জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় ১২ লাখ জনগণের চিকিৎসার জন্য ভরসার একমাত্র জায়গা রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল। ২০০৮ সালে সদর হাসপাতালটিকে ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ১০০ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকে কমপক্ষে ২০০ থেকে ২৫০ জন। ফলে শয্যা সংকটের কারণে বিছানা পেতে রোগীদের থাকতে হয় হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায়। এ ছাড়া, বহির্বিভাগে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে ১৫০০ থেকে ১৬০০ জন চিকিৎসা গ্রহণ করে ও জরুরি বিভাগে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ জন রোগী সেবা গ্রহণ করে থাকেন। রোগীর চাপের কথা চিন্তা করে ২০১৮ সালের মার্চে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজবাড়ীর ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কিন্তু কয়েক দফা কাজের মেয়াদ বাড়লেও এখনো ভবনটি বুঝে পায়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
মারুফ শেখ নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। কিন্তু কাউন্টার থেকে জানিয়ে দিলো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ নেই। জেলার বড় একটি হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট নেই এটি হতাশাজনক।
সজ্জনকান্দা গ্রামের বাসিন্দা আমিনুর রহমান নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমি চোখের সমস্যা দেখাতে সদর হাসপাতালে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি চোখের কোনো চিকিৎসকই এখানে নেই। জেলার একমাত্র বড় একটি হাসপাতালে চোখের কোনো চিকিৎসক নেই এটা খুবই দুঃখজনক। আমাকে এখন ৭০০/৮০০ টাকা ভিজিট দিয়ে প্রাইভেটভাবে দেখানো লাগবে।
শামীমা আক্তার নামের এক নারী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমি এলার্জির সমস্যাতে ভুগছি। আজ এসেছিলাম চর্ম রোগের ডাক্তার দেখাতে। টিকিট কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটতে গেলে সেখান থেকে জানানো হয় চর্ম রোগের কোনো ডাক্তার নেই। এখন বাধ্য হয়ে চলে যেতে হচ্ছে। জেলার আধুনিক একটি হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট লজ্জাজনক।
রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান বলেন, রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট দীর্ঘদিনের। বাইরের জেলা থেকে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ জেলায় আসতে চান না। গত অক্টোবর মাসের হাসপাতালের কর্মকর্তাদের হাল নাগাদ তথ্য ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) বরাবর পাঠিয়েছি। হাসপাতালের চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। পাশাপাশি গত ৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব স্যার বরাবর চিকিৎসক পদায়নের জন্য লিখিতভাবে জানিয়েছি। আমরা আমাদের দিক থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি চিকিৎসক সংকট দূর করার জন্য।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ২৫০ শয্যার ৮তলা ভবনের নির্মানকাজ প্রায় শেষের দিকে। গণপূর্ত অধিদপ্তর ভবনটি আমাদের কাছে হস্তান্তর না করলেও আমরা নতুন ভবনটি ব্যবহার করা শুরু করেছি। নিচতলায় টিকিট কাউন্টার সচল করা হয়েছে এবং দোতলায় কয়েকজন চিকিৎসক রোগী দেখছেন। খুব শিগগিরই আমরা ২৫০ শয্যার ভবনটি বুঝে পাবো বলে আশা করছি।
মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/এএমকে