ছড়ার পাশে খোঁড়া ছোট্ট গর্তই সুপেয় পানির একমাত্র ভরসা

‘আপনারা কি আমার পানি তোলার ছবি তুলছেন? আমি তো প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে এখানে পানি নিতে আসি’—ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথাগুলো বলছিল ৪ বছরের আকৃতি হাজং। মা স্বর্ণকা হাজংয়ের সঙ্গে পাহাড়ি ছড়ায় পানি নিতে এসেছে সে। তার মা ছড়ার পাশে গর্ত খুঁড়ে একটি বাটিতে করে কলসিতে খাবার পানি সংগ্রহ করছে। খেলার ছলে হাতভর্তি করে পানি তুলছে শিশুটি।
কিন্তু ছোট্ট আকৃতি জানে না এই পানি সংগ্রহ শুধু খেলা নয়, তাদের বেঁচে থাকার লড়াই। পাহাড়ি এই ছড়ার বহমান ধারা তাদের পরিবারের একমাত্র সুপেয় পানির উৎস।
শুধু আকৃতি হাজং ও তার মা স্বর্ণকা হাজংয়ের খাবার পানি নিয়ে সমস্যা বিষয়টি এমন নয়। নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার পাঁচগাও, চন্দ্রডিঙ্গাসহ বেশ কিছু গ্রামের কয়েকশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারে রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। এ সমস্যা নিরসনে তারা নিজেদের অর্থায়নে কিছু অগভীর নলকূপ স্থাপন করে দৈনন্দিন পানির চাহিদা পূরণ করেন। তবে তাদের টিউবওয়েল থেকে খাবার যোগ্য পানি সংগ্রহ করা যায় না। এর প্রধান কারণ টিউবয়েলের পানিতে রয়েছে অতিরিক্ত মাত্রায় আয়রন ও আর্সেনিক।
দেখা যায়, কলমাকান্দা সদর উপজেলা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বসবাস করেন গারো, ম্রং, হাজংসহ বেশ কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জন্মের পর থেকেই তারা সুপেয় পানির জন্য যুদ্ধ করে বড় হয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমতলে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হলেও, খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি তাদের জীবনযাত্রায়।
শুকনো মৌসুমে পাহাড়ি ছড়ায় অল্প পরিমাণে পানির প্রবাহ থাকে। তখন সেখান থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের দেখানো নিয়ম অনুযায়ী, ছড়ার পাশে ছোট গর্ত করে সেখান থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে ফিল্টার হওয়া পরিষ্কার খাবার পানি সংগ্রহ করে। কিন্তু বর্ষাকালে সুপেয় পানির সমস্যা তীব্র রুপ নেয়। কারণ শুকনো সময় পানির পরিমাণ কম থাকলেও পানি পরিষ্কার থাকে। কিন্তু বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি থাকে অপরিষ্কার। তখন খাওয়ার পানি সংগ্রহ করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য।
পানি সংগ্রহ করতে আসা স্বর্ণকা হাজংয়ের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, আমরা আদি যুগ থেকেই দেখছি এভাবে পানির সংগ্রহ করে আসছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। আমাদের এখানে ভালো কোনো টিউবওয়েল নেই। যেগুলো আছে সেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও আর্সেনিক থাকে। যার কারণে ওই টিউবওয়েলের পানি আমরা খেতে পারি না। তাই আমরা প্রতিদিন এই পাহাড়ি ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করি।
টিউবওয়েল বসানোর সুযোগ আছে কিনা এরকম প্রশ্নের জবাবে স্বর্ণকা বলেন, টিউবওয়েল বসানোর সুযোগ অবশ্যই আছে। কিন্তু গভীর নলকূপ বসাতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা আমাদের দ্বারা বহন করা সম্ভব না। এজন্য আমরা যুগের পর যুগ এভাবেই খাবার পানি সংগ্রহ করে আসছি।
সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে আসা আরেক আদিবাসী নারী নয়ন্তী হাজং বলেন, এখন যে সময় চলছে, এই সময়ে আমরা এভাবে হাত দিয়ে ছোট ছোট গর্ত তৈরি করে খাবার পানি সংগ্রহ করি। এছাড়া আমাদের সুপেয় পানি সংগ্রহ করার আর কোনো সুযোগ নেই। শুকনো কালে এখান থেকে কম বেশি খাবার পানি সংগ্রহ করতে পারি। কিন্তু বর্ষাকালে খাবার পানি সংগ্রহ করা কষ্ট হয়ে যায়। কারণ যতক্ষণ ঢলের পানি থাকে ততক্ষণ পানি সংগ্রহ করার কোনো সুযোগ থাকে না। ঢলের পানি নামলে পানি একটু পরিষ্কার হয়। তখন আবার আমরা খাবার পানি সংগ্রহ করি। আর যখন টানা বৃষ্টি ও ঢল থাকে তখন পানি সংগ্রহের জন্য আমরা অপেক্ষা করি কখন পানি পরিষ্কার হবে।
বিফল ম্রং নামের আরেক তরুণ আক্ষেপ করে বলেন, সবাই বলে পানির অপর নাম জীবন! কিন্তু আমরা বলি বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। মূলত আমাদের অঞ্চলে যে খাবার পানি পাওয়া যায় সেগুলো বিশুদ্ধ কিনা আমরা জানি না। কারণ আমরা পাহাড়ি ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করি। আমাদের এলাকায় টিউবয়েল নেই বললেই চলে। যেগুলো আছে সেগুলোর পানি পান করার উপযোগী না। এজন্য আমরা পাহাড়ি ঝর্ণার ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করি। আমরা মূলত সীমান্তে বসবাস করি। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না। জীবনমান খুবই নিম্নমানের। যেখানে আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ হয় না, সেখানে আমরা কিভাবে বসবাস করি আপনারা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। আমাদের দাবি একটাই, অন্তত আমাদের বিশুদ্ধ পানির একটা ব্যবস্থা করা হোক যেন পানির এই কষ্ট থেকে আমরা একটু মুক্তি পাই।

চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের সুবিমল ম্রং বলেন, আমাদের এই এলাকাটি খুবই প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল। আমাদের এই চন্দ্রডিঙ্গা গ্রাম রংছাতি ইউনিয়নের একবারে সীমান্ত এলাকা। আমাদের সুপেয় পানির সমস্যা খুব বেশি। কারণ বর্ডার অঞ্চলে যে এলাকাগুলো রয়েছে তার বেশিরভাগ এলাকাতেই ঝর্ণার পাশে কুয়ো খনন করে খাবার পানি সংগ্রহ করা হয়। এনজিও বলেন কিংবা সরকার, কেউই এখানে খোঁজ-খবর নেন না। পাশাপাশি প্রতি বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে আমাদের ফসলের ক্ষতি হয়। পাশাপাশি ঢলের সঙ্গে মাটি এসে কৃষি জমি নষ্ট করে দিচ্ছে।
অভিযোগের সঙ্গে তিনি বলেন, শুনেছি টিউবওয়েল দিচ্ছে, কিন্তু আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত স্থাপন করা হয় নাই। হয়তো প্রশাসনের লোকজন আমাদের সমস্যাগুলো জানে, কিন্তু তারা এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন না।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতা জন ক্রসওয়েল খকসী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশুদ্ধ খাবার পানির সমস্যা আমাদের বর্ডার এলাকার একটি অন্যতম সমস্যা। শুধু বর্ডার নয়, বর্ডার থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত পানির সমস্যা রয়েছে। আমার বাড়িতেও সুপেয় পানির সমস্যা। আমি অপারগ হয়ে প্রায় লাখ টাকা খরচ করে গভীর নলকূপ বসিয়েছি, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। হয়তো আর্সেনিকের সমস্যা সব জায়গায় নেই, তবে আয়রনের সমস্যা সব জায়গায় রয়েছে। এটা নিয়ে কারোর কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমাদের কমিউনিটির লোকজন প্রায় সময় আমার কাছে এসে দাবি জানায়- তাদের একটি ভালো নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা করার জন্য। কারণ অন্য কাজগুলো আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত পানি দিয়ে করা গেলেও খাবার পানি সংগ্রহ করার জন্য তাদেরকে পাহাড়ি ছড়ার উপর নির্ভর করতে হয়।
তিনি বলেন, মূলত পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এখানে মাটির নিচে পাথর থাকে, যার কারণে স্থানীয়ভাবে নলকূপ স্থাপন করলে বেশি গভীরে যাওয়া যায় না। যারা পাথর কেটে টিউবওয়েল বসাতে পারে ওই রকম লোক দিয়ে টিউবওয়েল বসাতে হবে, এছাড়া আর কোনো অপশন নেই। কিন্তু এত টাকা খরচ করে টিউবওয়েল বসানো দরিদ্র আদিবাসীদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের সুপেয় পানির সমস্যা তীব্র, যেটি আমাদের স্বাস্থ্যের অবনতির অন্যতম কারণ। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই, যেন আমাদের বিশুদ্ধ পানির এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। অবিলম্বে গভীর নলকূপ স্থাপনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাইযুল ওয়াসীমা নাহাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, সীমান্তে সুপেয় পানির অপর্যাপ্ততা রয়েছে এ বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে জনসাধারণকে ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করে দিচ্ছি। কয়েকটি পরিবারকে এক সঙ্গে করে যদি তারা আবেদন করেন, তাহলে আমরা হয়তো বা পরবর্তীতে তাদেরকে একটি ডিপ টিউবয়েলের ব্যবস্থা করে দিতে পারব।
আরকে