একাত্তরের এদিনে হানাদারমুক্ত হয় ভোলা

আজ ১০ই ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের আজকের এইদিনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লঞ্চযোগে ভোলা থেকে পালিয়ে যায়। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু তাজা প্রাণ,মা-বোনের সম্ভ্রম আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। দ্বীপজেলার মুক্তিকামী মানুষ পায় স্বাধীনতার স্বাদ। ভোলার আকাশে সেদিন প্রথম উড়ে লাল-সবুজের পতাকা, ভোলা পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। মুক্তিযুদ্ধের সেই দৃশ্যগুলো আজও চোখের সামনে ভাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভোলা ছিল ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে ও নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জলিল।
ভোলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে ১৯৭১ সালের এপ্রিলে মাসে এবং ভোলা শহরের যুগীরঘোলে অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ড ওয়াপদা দখল করে ক্যাম্প স্থাপন করে। সে ক্যাম্পে বীর মুক্তিযোদ্ধা,মুক্তিকামী নিরীহ মানুষ ও নারীদের ধরে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের পর চালানো হতো নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
পাকবাহিনী অসংখ্য লোককে হত্যা করে ওয়াপদার পাশে বধ্যভূমিতে মাটিচাপা দিত। পার্শ্ববর্তী ওয়াপদা প্রাঙ্গণেও অনেককে হত্যা করে সেখানে নিয়ে মাটিচাপা দিত। যুগিরঘোল ও ওয়াপদা এলাকায় হত্যাকাণ্ড চালায় জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড চালায় অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে।
বধ্যভূমিতে কত লোককে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। কারণ ভোলার অনেক এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় ওইসব এলাকার পরিবারগুলো অন্যত্র চলে গেছে। অনেক সংখ্যালঘু পরিবার দেশত্যাগ করেছে। তাছাড়া ভোলায় আশ্রয় নেওয়া লোকদেরও বন্দি করে ওয়াপদা অফিসে নিয়ে আসা হতো। তারপর সেখান থেকে কাউকে খেয়াঘাটে আবার কাউকে ওয়াপদায় বন্দি করে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। হত্যার পর কোনো-কোনো লাশ বধ্যভূমিতে গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হতো,আবার কোনো-কোনো লাশ নদীতে ফেলে দিত। প্রতি রাতেই পাকবাহিনী বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাঙালিদের হত্যা করত। ১০ ডিসেম্বর ভোলা হানাদার মুক্ত হওযার পর সেখানে অনেক কঙ্কাল দেখতে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় যে,এখানে অসংখ্য লোককে হত্যা করা হয়েছিল। বধ্যভূমি গণকবরে শায়িত শহীদদের মধ্যে ২৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে ৩ জন নারীও রয়েছেন।
১৯৭১ সালে ভোলা সরকারি স্কুল মাঠ, টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাঠসহ শহরের বেশ কিছু অংশে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলতো, এছাড়া অন্যান্য উপজেলাতেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ঘুইংগারহাট,বাংলাবাজার,বোরহানউদ্দিন,লালমোহন ও চরফ্যাশনে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা ভোলার অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ৮ ডিসেম্বর শহর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রস্তুতি নিলে ১০ ডিসেম্বর ভোররাতে পাকিস্তানি হানাদাররা ভোর ৫টায় শহরের পুরোনো লাশ কাটা ঘরের পাশে রাখা ইলিয়াস মাস্টারের কার্গো লঞ্চে চড়ে ভোলা থেকে পালিয়ে যায়।
তাদেরকে আটকানোর চেষ্টা চালায় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষ। পাক হানাদারদের বহনকারী ওই কার্গো লঞ্চটি চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে পৌঁছালে মিত্রবাহিনীর হামলায় তারা নিহত হন। এবং পাকিস্তানি বাহিনী ভোলা থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ভোলা হয় পাকহানাদারমুক্ত। পরে ১০ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের ছাদে ওঠে পাকিস্থানের পতাকা নামিয়ে সেখানে উড়িয়েছিল স্বাধীন দেশের লাল সবুজের পতাকা।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধা মো.সিদ্দিকুর রহমান ঢাকাপোস্টকে বলেন, ঘুইংগারহাট ও বোরহানউদ্দিনের দেউলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আমাদের হাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য ধরা পড়ে। এরপর আমরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ভোলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে যতটুকু সম্ভব হয়েছে যুদ্ধ চালিয়ে গেছি। এরমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা আরও বেড়ে গেল। ভোলার বিভিন্ন স্থান আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসলে সবাই শহরের দিকে আসেন। ৮ ডিসেম্বর ওয়াপদায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর ক্যাম্পে হামলার উদ্দেশ্যে আমরা ক্যাম্পের চারিদিকে অবস্থান নেই এবং আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি। পাকবাহিনী ভোলার সব জায়গা থেকে এসে ওয়াপদায় জড়ো হয়ে ১০ ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে পুরোনো লাশকাটা ঘর এলাকা থেকে ইলিয়াস মাস্টারের কার্গো লঞ্চ যোগে ভোলা থেকে পালিয়ে যাওয়ার খবরে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর আক্রমণ করেও তাদের আটকাতে পারেনি। মিত্রবাহিনীর কাছে ওয়ারলেসে খবর যাওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী যখন চাঁদপুর গেল, তখন মিত্রবাহিনী হেলিকপ্টার দিয়ে এসে বোমা নিক্ষেপ করলে লঞ্চে থাকা পাক বাহিনীর সবাই নিহত হয়। অন্যদিকে আমরা যখন শহরে ঢুকলাম তখন ১৬-১৭ জন রাজাকার পেলাম,তাদেরকে সেখানেই হত্যা করা হয়েছে।
ভোলার জেলা প্রশাসক ডা.শামীম রহমান ঢাকাপোস্টকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর ভোলা হানাদারমুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এদিন সকালে র্যালি হবে। র্যালি শেষে আলোচনা সভা হবে।
মো.খাইরুল ইসলাম/এমটিআই