এখন আর জ্বলে না মদন-বাবুর কুপি

দিনরাত খুটখাট শব্দ। বিরামহীন হাড়ভাঙা শ্রম। খাওয়াদাওয়ারও ঠিক নেই। বয়সের ছাপ চেহারায় স্পষ্ট। হাত আর হাতুড়ির মিশেলে প্রতিদিন তৈরি করছেন কুপি, কৌটা, মগ আর ক্যালেন্ডারের বিট। তবু ছাড়েননি হাল। শত কষ্টের মাঝেও জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে আঁকড়ে ধরে আছেন প্রিয় হস্তশিল্পকে।
বলছিলাম বাতির কারিগর মদনলাল আর বাবুলালের কথা। সম্পর্কে তারা দুজন ভাই। টিন দিয়ে কুপিসহ নানান পণ্য তৈরি করেন তারা। আর এসব বেচে সংসার চলে তাদের। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির দাপটে তাদের এই পণ্যের কদর এখন আর নেই। কুপির মতোই নিবু নিবু মদন-বাবুর জীবনপ্রদীপ।
হাড়ভাঙা শ্রম মদন-বাবুর নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে। কুপি তৈরি করে পার করেছেন তারা জীবনের ৬০ বছর। পাকিস্তান আমলে শুরু তাদের কুপি তৈরির কাজ। অন্যের ঘরে বাতির আলোর সংস্থান করতে গিয়ে কত কষ্টই না করেছেন তারা। কিন্তু আজ তাদের পড়ন্তবেলায় তাদের দিকে তাকানোর কেউ নেই। উন্নয়ন, আধুনিকতা আর প্রযুক্তির মারপ্যাঁচে মদন-বাবুর কুপি বাতির নিচে এখন অন্ধকার। তারপরও খুটখুট শব্দে কুপি তৈরি করে পাচ্ছেন দুটি পয়সা, তা-ই নিয়ে খুশি তারা। কিন্তু দুই ভাইয়ের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
তারা জানান, রংপুর মহানগরের কালীবাড়িতে একটা ঝুপড়ি ঘরে তাদের কুপি তৈরির কারখানা ছিল। এখন রংপুর প্রেসক্লাবের বিপরীতে পুরাতন ধর্মসভার কোলঘেঁষে একটা ছাপরায় সারাদিন খুটখাট করে কুপি তৈরি করেন দুই ভাই। বয়সে দুই বছরের ছোট বড় মদর-বাবুর মাথায় এখন একই চিন্তা। বিয়ের উপযুক্ত মেয়ের মুখে হাসি আর স্ত্রী-সন্তানদের একটু সুখ তাড়া করে বেড়ায় দুই ভাইকে।
ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক যখন মদনলাল আর বাবুলালকে ক্যামেরায় বন্দি করছিলেন, তখন কানে ভেসে এল ‘তেল গেল ফুরাইয়া, বাতি যায় নিভিয়া, কী হবে আর কান্দিয়া’ গানের কলি। বাংলা ছায়াছবি ‘ত্যাগ’র জনপ্রিয় এই গান গাইতে গাইতে মদনলাল রোগা শরীরে কাশতে কাশতে বললেন, এখন তেল থাকলেও আমার কুপি অচল। সবার ঘরে ঘরে সস্তা বাল্ব জ্বলে। মানুষ এখন আর ল্যাম্প (কুপি) কেনে না।

মদনলাল আক্ষেপ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগের মতো এখন তাদের ব্যবসা নেই। করোনাকালে তারা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। একসময় দিনে খুচরা-পাইকারি মিলে একশরও বেশি কুপি বিক্রি হতো। এখন মাসেও ১০টাও বিক্রি হয় না। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির আলোয় সব জায়গা আলোকিত। সারাজীবন মানুষের ভাঙাচোরা টিনের বালতি, বাসন-কোসন জোড়াতালি দিলাম। অথচ নিজের জীবনটাই আর জোড়াতালি দেওয়া হলো না।
বিক্রি নেই, তাই বলে কি গল্প করলে চলবে? এমনটা বলে থেমে গেলেন মদনলাল। কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে কথা জুড়ে দেন ছোট ভাই বাবুলাল পাল। ‘আমার ভাইয়ের আগের মতো কষ্ট নেই। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। তিন ছেলের একজন শিক্ষক, বাকি দুজন ব্যবসা করে। কিন্তু যত বিপদ আমার ওপর। থাকার মতো এক শতক ভিটে মাটি ছাড়া কিছু নেই। কোনোরকমে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখনো ঘরে দুই মেয়ে আছে। একমাত্র ছোট ছেলেটা ক্লাস সিক্সে পড়ছে।’ এসব কথা বলতে বলতে বাবুলালও থমকে গেলেন । যেন দুঃখের ভারে দম খাটো হয়ে আসছে তার।
বাবুলাল বলেন, দিন গেলেই বাড়ির খরচ কম করে হলেও ৩০০ টাকার ওপর লাগে। কোনো দিন ২৫০ হয়, আবার ১০০ টাকাও রোজগার হয় না। অথচ বাজারে সব জিনিসপত্রের দাম বেশি। আমাদের মতো মানুষের কষ্টের শেষ হবে না। এভাবেই একদিন মরে যাব, কুপিও তৈরি থেমে যাবে। সেদিন আমার কষ্টও শেষ হবে।
প্রযুক্ত আর আধুনিকতাকে সবাই ছোঁবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই পেশাও বদল করেছেন। কিন্তু মদন-বাবুর অন্য কোনো কাজকর্ম জানা না থাকায় বাপ-দাদার পেশাকেই আঁকড়ে ধরে আছেন। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে মদনলাল আর বাবুলালের সংসার চলছে কোনোমতে।
এদিকে করোনাকালে এই পেশায় কুপি, কৌটা, মগ আর ক্যালেন্ডারের বিট তৈরির চাহিদা কমে এসেছে। আগের মতো ছোট ছোট মেরামতের কাজও নেই তাদের। পরিবারের সবাই যখন যে যার মতো চলছে, তখন একটু ভালো থাকার জন্য দুই ভাইয়ের চাওয়া, তাদের তৈরি করা টিনের কুপি, কৌটা ও মগের বিক্রি বাড়ুক।
এনএ