পর্যটনকেন্দ্র যখন মৃত্যুকূপ

চাঁদপুরের বড়স্টেশন মোলহেড এলাকার কাছে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর সংযোগ ঘটেছে। নদীগুলো তিন দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাওয়ায় সেখানে সৃষ্টি হয় পানির বিশাল এক ঘূর্ণিস্রোত।
এই দৃশ্যটি দেখতে তিন নদীর মোহনা চাঁদপুর বড়স্টেশন মোলহেডে দর্শনার্থীরা ভিড় জমান। মহামারি করোনাভাইরাস বিপর্যয়ের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর খুলে দেওয়া হয়েছে চাঁদপুরের পর্যটনকেন্দ্র বড়স্টেশন মোলহেড।
চারপাশ থেকে তীব্র স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। ভয়ংকর ওই ঘূর্ণিপাকে কিছু পড়লে তার আর হদিস মেলে না। এমনকি বড় বড় যাত্রীবাহী লঞ্চও তলিয়ে গেছে এখানে। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর বর্ষার মৌসুমে অনেক মালবাহী কার্গো তীব্র স্রোতে ডুবে গেছে।
যেগুলোর সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। চাঁদপুরের ত্রিনদীর মিলনস্থলটিকে অনেকে ট্রায়াঙ্গল নামেই চিনেন। বর্ষায় নদীর পানি বৃদ্ধিতে তিন নদীর মিলনস্থল মৃত্যুকূপে পরিণত হয়।
চাঁদপুরে মেঘনা নদীর সীমানা ৩৬০ দশমিক ১১ কিলোমিটার। এর মধ্যে এই নদীগুলো তিন দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাওয়ায় এখানে সব সময় পানির বিশাল ঘূর্ণিগর্তের সৃষ্টি হয়। এই ঘূর্ণিগর্তই এলাকাটিকে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও জাহাজ চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চাঁদপুর বড়স্টেশন মোলহেডে ২৪ ঘণ্টায় প্রবল ঘূর্ণিস্রোত বইতে থাকে। প্রতি সপ্তাহে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে এই স্থানে। বেশির ভাগই মালবোঝাই জাহাজ কিংবা কার্গোডুবির মতো ঘটনা ঘটছে এখানে। মোহনায় স্রোত থাকায় কখনোই নৌযান উদ্ধার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
বিভিন্ন সূত্রে থেকে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে তিন নদীর মিলনস্থলে তীব্র ঘূর্ণিস্রোতের কবলে পড়ে নিমজ্জিত হয় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চাঁদপুরগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি দিনার-২। এতে কমপক্ষে দেড়শতাধিক যাত্রীর মৃত্যু হয়।
মোহনায় ২০০৩ সালের ৮ জুলাই এমভি নাসরিন-১ লঞ্চ ডুবিতে মারা যান ১১০ জন, নিখোঁজ হন ১৯৯ জন। এছাড়া ২০০৮ সালেও একই স্থানে নৌকাডুবিতে ২ জেলের মৃত্যু হয়। সব লঞ্চেই প্রচুর যাত্রী ছিল। অতিরিক্ত স্রোত থাকার কারণে অধিকাংশ যাত্রী মারা যায়। এ পর্যন্ত এখানে ডুবে যাওয়া কোনো লঞ্চের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রতিবছর বিভিন্ন সময়ে ডুবে যাওয়া কার্গোগুলোরও হদিস মেলেনি।
বড়স্টেশন মোলহেডে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী শুভ ও শাহরিয়ার শান বলেন, তিন নদীর মোহনাটি যেমন অসম্ভব সুন্দর, তেমনি এটি ভয়ংকরও। প্রতিবছর তীব্র স্রোতের কারণে এখানকার সিসিব্লক দেবে যায়। অসংখ্য জাহাজ এখানে ডুবে গেছে। স্রোতে কোনো কিছু পড়লে তার আর খোঁজ পাওয়া যায় না।
তারা আরও বলেন, প্রতিদিন চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে মানুষ ঘুরতে আসেন। অনেকেই সাহস করে তীব্র স্রোতের মধ্যে ট্রলার নিয়ে ঘুরে বেড়ান। আমরা যতটুকু জানি, পশ্চিম পাশের চরের কারণে এখানে স্রোত সৃষ্টি হয়। আর এই স্রোতে শহররক্ষা বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

প্যানেল মেয়র ফরিদা ইলিয়াস বলেন, বড়স্টেশন মোলহেডে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষ সময় কাটায়। এখানকার পরিবেশ খুবই সুন্দর। বছরের এই সময়ে শুধু এখানে ঘূর্ণিস্রোত সৃষ্টি হয়। স্রোতের কারণে শহররক্ষা বাঁধও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিপরীত পাশের ডুবোচর কেটে ফেললে স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন হবে। তখন এখানে ঝুঁকি কমে আসবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপপরিচালক এসএম রিফাত জামিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোলহেডের ঘূর্ণিস্রোত নিয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞরা কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া চর কাটার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। এখনো আমরা অনুমোদন পাইনি।
চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক কায়সারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বর্ষার প্রথম মৌসুমেই মোহনায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে বিজ্ঞপ্তি জারি করি। প্রয়োজনছাড়া যাতে এই স্থানে কোনো ট্রলার, স্পিডবোট, কার্গো জাহাজ চলাচল না করে।
যাত্রীবাহী লঞ্চ ও কার্গোগুলোকে যতটুকু সম্ভব ঝুঁকি এড়িয়ে চলাচল করতে বলা হয়েছে। পর্যটকরা যাতে এই সময়ে নদীতে না নামেন তার জন্য মাইকিং করা হয়। এছাড়া নির্দেশনা মেনে চলতে বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশ নদীতে টহল দিয়ে থাকে বলে জানান তিনি।
এমএসআর