রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর পর্যটন কতটা নির্ভরশীল?

পর্যটন পৃথিবীর অন্যতম দ্রুত বিকাশমান অর্থনৈতিক খাত যেহেতু উন্নত এবং উন্নয়নশীল—উভয় ধরনের দেশেই জাতীয় আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে পর্যটন খাতকে বিবেচনা করা হয়। পর্যটন খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের শিল্প থেকে জীবিকা ব সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। পর্যটন শিল্প থেকে সরাসরি, পরোক্ষ এবং উদ্দীপিত উপায়ে আয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
পৃথিবীতে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন এ শিল্প থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে এই খাতটি অত্যন্ত সংবেদনশীল; যেহেতু অর্থনীতি, পরিবেশ, প্রযুক্তি, সমাজের প্রভাব থাকলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পর্যটনের সবচেয়ে বড় নির্ধারক হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, পর্যটকরা ভ্রমণের সময় নিরাপত্তা, শান্ত পরিবেশ, উন্নত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নীতিগত স্থায়িত্বকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, নির্বাচন-সংক্রান্ত অস্থিরতা, সরকার পরিবর্তন, নীতিগত অসঙ্গতি অথবা রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বের প্রভাব সরাসরি পর্যটন খাতে প্রতিফলিত হয়।
রাজনৈতিক স্থিতি বলতে এমন একটি পরিবেশকে বোঝায় যেখানে রাষ্ট্রে নিয়মিত শাসনব্যবস্থা বজায় থাকে, নীতি বাস্তবায়ন ধারাবাহিক থাকে, চরম রাজনৈতিক সহিংসতা নেই এবং পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা বিদ্যমান। রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ বিনিয়োগবান্ধব এবং পর্যটকের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করে। পর্যটন খাতের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যত দৃঢ়, পর্যটকের আগমন তত বেশি। একজন পর্যটক গন্তব্য নির্বাচন করার সময় আকর্ষণীয় স্থানের পাশাপাশি স্থানের নিরাপত্তা, পরিবেশের পূর্ব ধারণা, গণমাধ্যমের প্রচার এবং সরকারের স্থিতিশীলতাকে বিশেষভাবে বিবেচনা করে।
পর্যটন চাহিদা অত্যন্ত ‘সংবেদনশীল’ এবং ‘ঝুঁকি-এড়ানো প্রবণ’। যেকোনো ধরনের সহিংসতা, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, বিক্ষোভ, সন্ত্রাসী হামলা কিংবা সামান্য অস্থিরতাও পর্যটকের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। United Nations World Tourism Organization (UNWTO) প্রতিটি রিপোর্টে উল্লেখ করে—নিরাপত্তা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা পর্যটন বৃদ্ধির প্রধান শর্ত।
রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলেই আন্তর্জাতিক ভ্রমণ সতর্কতা জারি হয়, পর্যটন সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায়।
পর্যটন একটি বিলাস-নির্ভর বা স্বেচ্ছামূলক ব্যয়; তাই সামান্য ঝুঁকিও পর্যটককে গন্তব্য পরিবর্তনে বাধ্য করে। পর্যটন-রাজনীতি সম্পর্কের অন্যতম প্রখ্যাত গবেষক সেভিল এফ. সনমেজ [Sevil F. Sonmez] যুক্তি দেন যে, ‘রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পর্যটন চাহিদার প্রধান নির্ধারক।’
পর্যটকরা রাজনৈতিক ঝুঁকি যুক্ত যতই আকর্ষণীয় গন্তব্য থাকে তা এড়িয়ে চলে। একইসাথে সহিংসতা বা সন্ত্রাসী হামলার পর পর্যটন শিল্পে সাথে সাথেই ধস নামে। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ভ্রমণ নিজ দেশের দূতাবাস বা সরকারের ভ্রমণ-নির্দেশনার ওপর নির্ভর করে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে এরকম সরাসরি ‘অ্যাভয়েড ট্রাভেল’ বা ‘এসেনশিয়াল ট্রাভেল অনলি’ অথবা ‘রেড এলার্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে পর্যটকদের ভ্রমণ বাধাগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে, মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচার একটি দেশের পর্যটন ব্র্যান্ডকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ মিসরে ২০১১ সালের আরব বসন্ত আন্দোলনের সময় পর্যটক সংখ্যা দ্রুত কমে যায় এবং সেটি পুনরুদ্ধারে এক দশকেরও বেশি সময় লেগে যায়। গবেষক এরিক নিউমায়ের [Eric Neumayer] নিজস্ব একটা ডাটাবেজ ব্যবহার করে দেখান যে, রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘর্ষ, বিদ্রোহ, সামরিক অস্থিরতা পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি অর্থাৎ অস্থিরতা শেষ হলেও পর্যটক দ্রুত ফিরে আসে না এবং ওই দেশের পর্যটন শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
উদাহরণ হিসেবে, শ্রীলঙ্কায় ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষে পর্যটনে দ্রুত প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও ২০১৯ সালের ‘ইস্টার অ্যাটাক [Sri Lanka Easter Bombings]’ রাজনৈতিক নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর ফলে ওই দেশের পর্যটন শিল্প আবার সংকটে পড়ে। হামলার পরপরই পর্যটকের আগমন ৭০ শতাংশ কমে যায়।
রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ বিনিয়োগবান্ধব এবং পর্যটকের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করে। পর্যটন খাতের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যত দৃঢ়, পর্যটকের আগমন তত বেশি।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ ও সহিংস ঘটনার পর পর্যটকের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে ১৫ শতাংশ কমে যায়। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক বিক্ষোভ এবং সামরিক অভ্যুত্থান পর্যটক সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে ফেলে। সেসময় পর্যটকের আগমন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়।
অন্যদিকে ফ্রান্সের পারিসে ২০১৫ সালে হামলার পর পর্যটকের সংখ্যা ১০ শতাংশ কমে যায় এবং এশিয়ান পর্যটক ২০ শতাংশ কমে যায়। এই উদাহরণগুলো স্পষ্ট করে যে, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পর্যটন খাতের প্রাণশক্তি। অপরদিকে, পর্যটন শিল্পে অবকাঠামো, রিসোর্ট, হোটেল, যাতায়াত, মোটেল, পরিবহন, থিম পার্ক বা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগে নীতিগত পরিবর্তন ঘটায়, ফলে বিনিয়োগ অনেকক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে অর্থ লগ্নি করতে অনিচ্ছুক হয়, বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পায়, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বিলম্বিত বা স্থগিত হয়, পর্যটন নীতি বা ট্যাক্স নীতিতে হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে ফলে এই শিল্পের প্রসার কমে যায়।
হিচনার ও ব্রুম [Dennis R. Hichner and Robert W. Broom] প্রমাণ করেন যে, রাজনৈতিক স্থিতি না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না; ফলে পর্যটন অবকাঠামো দুর্বল থাকে, যা পর্যটক কমায়। যেসব দেশে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল সরকার টেকসই নীতি বাস্তবায়ন করেছে, সেসব দেশ পর্যটনে এগিয়ে আছে যেমন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত।
এছাড়া অবকাঠামো ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করা যায় যে, একটি দেশের পর্যটন নির্ভর করে উন্নত রাস্তা, রেল, বিমান যোগাযোগ, নিরাপদ পরিবহন, মানসম্মত আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও তথ্যপ্রযুক্তি সুবিধার ওপর। বিখ্যাত গবেষক হল ও ও’সুলিভান [Haul and O'Sullivan], পর্যটন নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বলেন, ‘পর্যটন একটি শান্তিপ্রিয় শিল্প। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হলে পর্যটক কমে যায়।’
আরও পড়ুন
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে সরকার বড় প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান প্রয়োগ করতে পারে, আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর ও পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারে, বিপরীতে, অস্থিতিশীলতা সরকারি তহবিলকে নিরাপত্তা ব্যয়ে সরিয়ে দেয়, ফলে উন্নয়ন প্রকল্প স্থবির হয়।
যদিও একটি দেশের আন্তর্জাতিক চিত্র বা ইমেজ পর্যটক আকর্ষণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তদুপরি রাজনৈতিক অস্থিরতা সাধারণত গণমাধ্যমে নেতিবাচক চিত্র তৈরি করে, দেশের ব্র্যান্ড ভ্যালু কমে যায়, দীর্ঘমেয়াদি বিপণন খ্যাতি ক্ষতিগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জর্ডান বা মরক্কো রাজনৈতিকভাবে তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকায় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অস্থির দেশগুলোর তুলনায় বেশি পর্যটক আকর্ষণ করেছে।
আবার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে পর্যটন শিল্প থেকে আয় কমে যায়, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পর্যটনের সাথে জড়িত যেমন, হোটেল, পরিবহন, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, ট্রাভেল এজেন্সি, স্থানীয় কারুশিল্প ও হস্তশিল্প, সবই অস্থিরতাসহ বিভিন্ন ক্ষতির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশের উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—রাজনৈতিক অবরোধ, হরতাল, ‘শাট ডাউন’, পরিবহন বন্ধ ইত্যাদি পরিস্থিতিতে স্থানীয় পর্যটক চলাচলও কমে যায়, বিদেশি পর্যটকের বাংলাদেশ ভ্রমণের তো প্রশ্নই আসে না। দেশে ‘রেড এলার্ট’ জারি হলে সাধারণ সময়ে যেসব পর্যটক আসতে চাইতো তারা আর আসে না।
লিন্ডা কে. রিখটার [Linda K. Richter] (১৯৮৩) পর্যটনকে ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘পর্যটন এবং রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক; রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নীতি পরিবর্তন, নেতৃত্ব পরিবর্তন—সবকিছুই পর্যটনকে সরাসরি প্রভাবিত করে; কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা দুর্বল হলে পর্যটনও দুর্বল হয়।’
পর্যটন এবং রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক; রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নীতি পরিবর্তন, নেতৃত্ব পরিবর্তন—সবকিছুই পর্যটনকে সরাসরি প্রভাবিত করে; কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা দুর্বল হলে পর্যটনও দুর্বল হয়।
পর্যটন খাত সংকটের পরে দ্রুত পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সরকারের দ্রুত সহায়তা নীতি বাস্তবায়ন করা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা, মিডিয়ায় ইতিবাচক বার্তা প্রচার, আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলার মাধ্যমে ব্র্যান্ডিং, বিনিয়োগে প্রণোদনা ইত্যাদি।
যেসব দেশ শক্তিশালী ও স্থিতিশীল প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে সংকট-পরবর্তী সময়ে দ্রুত পুনরুদ্ধার করেছে, তার মধ্যে অন্যতম—রুয়ান্ডা, ভিয়েতনাম, দুবাই—তারা এখন সফল পর্যটন গন্তব্য। এদিকে, বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা অত্যন্ত সমৃদ্ধ—কক্সবাজার, সুন্দরবন, পাহাড়ি অঞ্চল, নদী ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোনে অন্তর্ভুক্তি পর্যটন শিল্পকে আরও বেশি সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। বাংলাদেশের আছে বিশাল সমুদ্রসীমা এবং জালাধার। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পর্যটকের সংখ্যা ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। এটা সুনিশ্চিত রাজনৈতিক স্থবিরতা বা অনিশ্চয়তা, অবরোধ, পরিবহন নিরাপত্তাহীনতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নীতির ধারাবাহিকতার অভাব আন্তর্জাতিক পর্যটকের আগমনের হারকে কমিয়ে দেয়।
যদি বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল শাসন, নীতিগত ধারাবাহিকতা, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং শক্তিশালী ব্র্যান্ডিং বজায় রাখতে পারে, তাহলে পর্যটন খাত জিডিপি বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক স্থিতি পর্যটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। নিরাপত্তা, নীতি, বিনিয়োগ, অবকাঠামো, ব্র্যান্ডিং, অর্থনীতি—সবকিছুই রাজনৈতিক আবহাওয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পর্যটন সবচেয়ে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পুনরুদ্ধারে বেশি সময় নেয়।
তাই যেকোনো দেশের টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা পরিবেশ এবং নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। অন্যথায় পর্যটন খাত তার সম্ভাবনা অনুযায়ী বিকশিত হতে পারে না।
সামশাদ নওরীন : সহযোগী অধ্যাপক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়