৪৯ বছরেও অরক্ষিত রংপুরের বধ্যভূমি-গণকবর

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হতে চলছে। এখনও রংপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো পুরোপুরি সংরক্ষণের আওতায় আসেনি। নির্মিত হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ বা শহিদদের নামফলক। একাত্তরের শহিদদের স্মৃতিবিজড়িত কিছু বধ্যভূমি সংস্কার করা হয়েছে। তবে সেগুলোর নেই যথাযথ সংরক্ষণ। অনেক জায়গায় বছরের পর বছর অযত্ন আর অবহেলায় অরক্ষিতভাবে পড়ে থাকা বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী মুক্তিকামী বাঙালিদের কোনো ছাড় দেয়নি। স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তারই রক্ষমাখা নীরব মাটি ও সাক্ষী বধ্যভূমি এবং গণকবরগুলো। বিভিন্ন সময়ে রংপুরে বধ্যভূমি থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। অথচ এখনও বেশির ভাগ বধ্যভূমি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে। তবে প্রশাসন বলছে, অনেক বধ্যভূমি ও গণকবর সংস্কার করা হয়েছে। বাকিগুলোর কাজও পর্যায়ক্রমে করা হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুরের অধিকাংশ বধ্যভূমি ময়লা-আবর্জনার স্তূপে ঢাকা। নেই যাতায়াতের রাস্তা। নির্দিষ্ট দুই একটি দিন ছাড়া সারা বছরই বধ্যভূমিগুলো থাকে অরক্ষিত। চারপাশে খোলা আবার কোনোটা গরু-ছাগলের চারণভূমি। দিনের আলো শেষে সন্ধ্যায় অন্ধকারে থাকে সূর্য সন্তানদের স্মৃতিচিহ্ন। দেখাশুনার লোক না থাকায় কখনও বধ্যভূমি হয়ে উঠছে মাদকাসক্তদের আড্ডাখানা। কোথাও কোথাও ব্যক্তি দখলের নেয়ার চেষ্টা চলছে। আবার হঠাৎ দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটা বধ্যভূমি আর কোন জায়গায় রয়েছে গণকবর। বেশির ভাগ বধ্যভূমিতে নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানানোর জন্য নেই তথ্য নির্ভর কোনো নামফলক ও শহিদদের তালিকা।
জানা গেছে, রংপুরে ছোট-বড় অনেক বধ্যভূমি থাকলেও সরকারিভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র ১৩টি। সেগুলো হলো- রংপুর টাউন হল, দখিগঞ্জ শ্মশান, সাহেবগঞ্জ, দমদমা, বালার খাইল, নব্দীগঞ্জ, লাহিড়ীরহাট, ঘাঘট নদী, নিসবেতগঞ্জ, জাফরগঞ্জ ব্রিজ, বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ার বিল ও পদ্মপুকুর এবং মিঠাপুকুর উপজেলার জয়রাম আনোয়ারা বধ্যভূমি। এছাড়াও জানা-অজানার মধ্যে রয়েছে মডার্ন সিনেমা হল, কুকুরুন বিল, নারিরহাট, শংকরদহ, বৈরাগীগঞ্জ, বলদিপুকুর, দেবীপুর, শিবগঞ্জ এলাকা বধ্যভূমি এবং রংপুর সেনানিবাস গণকবর।
রংপুরের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝাড়ুয়ার বিল ও পদ্মপুকুর। ১৯৭১ সালে ঝাড়ুয়াল বিলে একসঙ্গে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে পাকিস্তানি হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর পর ২০১৬ সালে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে।
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের হাজিরহাট এলাকায় জাফরগঞ্জ ব্রিজের পাশে রংপুর শহরের ব্যবসায়ী অশ্বিনী ঘোষসহ ১৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ব্রিজের ওপর দুই দিনে ১০ জনকে হত্যা করা হয়। সেখানে আজও কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না জাফরগঞ্জ ব্রিজ বধ্যভূমির কথা।
রংপুর টাউন হল ছিল পাকিস্তানি হায়েনাদের ফূর্তি করার জায়গা। এটাকে টর্চার সেল বানানো হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাদের নারী নির্যাতনের একটি প্রধান কেন্দ্র এই টাউন হলে মেয়েদেরসহ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিকামী মানুষদের আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন শেষে মেরে ফেলা হতো। এর পেছনের একটি কূপে ওই সব লাশ ফেলে দেয়া হতো। সম্প্রতি টাউন হল চত্বর বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজের জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে ওই কূপ থেকে বেশ কিছু হাড়গোড় পাওয়া গেছে। সেগুলো সংগ্রহে রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
রংপুর শহরের নিসবেগঞ্জ এলাকায় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ২৩তম ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ অবাঙালি পাকিস্তানি সেনা অফিসার লে. আব্বাসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শহরে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ফলে ২৮ মার্চ হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ তীর-ধনুক-বল্লম-লাঠি-দা-কুড়াল এবং বাঁশের লাঠি হাতে রংপুর সেনানিবাস আক্রমণের উদ্দেশ্যে ঘাঘট নদের তীরে জমায়েত হতে থাকে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অসংখ্য মানুষ। ঘাঘট নদের পানি সেইদিন হাজারো শহিদের রক্তে লাল হয়ে যায়। এতে এই ঘাঘট নদের তীর একটি বৃহৎ বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। সেখানে শহীদদের স্মরণে রক্তগৌরব নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে দুই মাইল দক্ষিণ-পূর্বে দমদমা সেতুর নিচে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। এখানে ৩০ এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক রামকৃষ্ণ অধিকারী, কালাচাঁদ রায়, সুনীলবরণ চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন রায়সহ আরও অনেককে হত্যা করে পাকিস্তোনি সেনাবাহিনী। প্রায় প্রতিদিন এখানে বাঙালিদের হত্যা করা হতো। এই বধ্যভূমিটি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংরক্ষণে নামমাত্র দায়িত্ব নিয়েছে। পুরো বধ্যভূমি এখনও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।
রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানঘাটে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের দুটি মেস থেকে ১১ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই দলে মন্টু ডাক্তারের সঙ্গে ছিলেন রংপুরের ভাসানী ন্যাপ নেতা ইয়াকুব মাহফুজ আলী। অলৌকিকভাবে সেই দিন বেঁচে যান মন্টু ডাক্তার। এই বধ্যভূমিতে নামফলক ও শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে।
রংপুর জেলখানা থেকে ১৯ জন বন্দী ইপিআর সদস্যকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। হারাগাছ রোড ও সাহেবগঞ্জের মাঝামাঝি একটি স্থানে এই শহিদদের গণকবর রয়েছে।
রংপুরের গঙ্গাচড়ার তিস্তা তীরবর্তী শংকরদহ গ্রামে ১৯৭১ সালে ঘটেছিল এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তানি বাহিনীর বুলেট কেড়ে নেয় ১৭ জনের প্রাণ। এর মধ্যে মসজিদে নামাজ আদায়রত অবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ারে ছয়জনকে হত্যা করে। স্বাধীনতার এত বছর পরও সরকারিভাবে শংকরদহ বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। এমনকি বেশির ভাগ মানুষই সেই বধ্যভূমি সম্পর্কে অজানা।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এসব বধ্যভূমিসহ মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট সকল স্থাপনা সংরক্ষণে সরকারকে আরও গুরুত্ব বাড়াতে হবে বলে মনে করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক উমর ফারুক।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত এমনভাবে বধ্যভূমিগুলোকে সংরক্ষণ করা এবং ফুটিয়ে তোলা, যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বেঁচে থাকে। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আকাঙক্ষা, স্বাধীনতা সংগ্রামের কষ্ট-অর্জন অজানা থেকে যাবে।
এ ব্যাপারে রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর হোসেন চাঁদ বলেন, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত অনেক বধ্যভূমি আজও অরক্ষিত। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর লক্ষ্যে বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা জরুরি।
প্রজন্ম একাত্তর রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি দেবদাস ঘোষ দেবু বলেন, আমার বাবাসহ অনেক মুক্তিকামী মানুষকে জাফরগঞ্জ ব্রিজে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা। সেখানে আজও কোনো নামফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ নেই। এমন আরও অনেক জায়গা রয়েছে, যা আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। সেগুলো সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে বধ্যভূমি এবং গণকবর সংস্কারের জন্য সরকার কাজ করছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের রংপুর জেলা ও বিভাগীয় সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু।
তিনি বলেন, রংপুরে যে সব বধ্যভূমি এখনও অরক্ষিত রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী এক বছরের সেগুলো দৃশ্যমান হবে।
অন্যদিকে পর্যায়ক্রমে সব বধ্যভূমি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হবে বলে জানিয়েছেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল ওহাব ভূঞা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রমাণ এসব বধ্যভূমি। বধ্যভূমিগুলো ইতিহাসের অংশ। আমরা পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বধ্যভূমি সংস্কার এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছি। এর পাশাপাশি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ ও নামফলক বসানো হবে।
আরএআর