বরিশাল সিটির ৪ পদধারী কর্মকর্তা স্বপনের কত ক্ষমতা!

বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতসহ ১৯ কর্মকর্তার ঘুষ-দুর্নীতিসহ অবৈধ সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে ১৮ জন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নথি সংগ্রহ করেছে দুদকের বরিশাল অফিস।
এর মধ্যে বিগত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া পরিসংখ্যানবিদ স্বপন কুমার দাসের পদ নিয়েই গোলকধাঁধায় পড়েছে দুদক। তার ব্যক্তিগত নথি, বেতন নেওয়ার শিট কিংবা হাজিরাখাতা অনুসারে তিনি পরিসংখ্যানবিদ। কিন্তু আগলে রেখেছেন একাধারে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অবৈধ উচ্ছেদ শাখার প্রধান, মশক নিধন শাখার প্রধানের পদ। আবার কখনো কখনো তিনি জনসংযোগ বিভাগেও দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ সিটি কর্পোরেশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশনে প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি লোকবল রয়েছে। তাহলে একজন কর্মকর্তা কীভাবে বা কার ক্ষমতায় এতগুলো পদের দায়িত্ব পালন করছেন সেটাই বড় প্রশ্ন।
যদিও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী দাবি করেছেন স্বপন কুমার দাসের বর্তমান পদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, দুদক থেকে বেশকিছু কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নথি চাওয়া হয়েছিল, তা পাঠানো হয়েছে। আগের মেয়রের সময়ের কিছু অভিযোগ নিয়ে দুদক কাজ করছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে স্বপন কুমার দাসের বর্তমান পদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি পরিসংখ্যানবিদ নন। তিনি পরিসংখ্যানবিদ ছিলেন, সেটা আগের মেয়রের সময় পরিবর্তন হয়েছে। তাকে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যানবিদ পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সময়ে ২০২৩ সালের এপ্রিল-মে মাসের দিকে তাকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে আইনি জটিলতায় তা আর কার্যকর হয়নি। স্বপন কুমার দাস এখনো পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। হাজিরাখাতাতেও ওই পদেই সই দিতে হয়। একজন ব্যক্তি চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে পুরো প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছেন –এটি নজিরবিহীন এবং শুদ্ধাচার নীতিমালার পরিপন্থি।
অন্যদিকে, সিটি কর্পোরেশনের জুলাই মাসের হাজিরাখাতার স্বাক্ষর ও সর্বশেষ জুন মাস বা তার আগের মাসের বেতনের নথিও বলছে স্বপন কুমার দাস কাগজে-কলমে এখনো পরিসংখ্যানবিদ। অথচ পরিসংখ্যানবিদ শূন্য ঘোষণা দিয়ে জনবল নিয়োগের জন্য গত ২৩ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সিটি কর্পোরেশন-১ শাখার যুগ্ম সচিব মাহবুবা আইরিন সই করা চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরও পড়ুন
পরিসংখ্যানবিদসহ ৮ শূন্য পদে জনবল নিয়োগের চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবা আইরিন বলেন, এ বিষয়ে আমার ধারণা নেই, আপনি বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে কথা বলেন। ওরাই ভালো বলতে পারবে। ওটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, আমি বলতে পারব না। আমি কেবল ছাড়পত্র প্রদান করেছি। ভেতরের খবর আমার জানার কথা নয়।
অন্যদিকে, অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকে সাবেক মেয়রের সময়ের বিভিন্ন কাজ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ডজনের বেশি কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এর মধ্যে স্বপন কুমার দাসও রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, পদ দখল ও দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। তার একাধিক পদের দায়িত্ব পালনের আইনগত বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। তিনি কোন ক্ষমতাবলে এতগুলো পদের দায়িত্ব পালন করছেন তা আমরা খতিয়ে দেখব।
ক্ষমতাধর স্বপনের দুর্নীতিকাণ্ড
২০১৪ সালে তৎকালীন মেয়র আহসান হাবিব কামালের সময়ে সিটি কর্পোরেশনে পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে নিয়োগ পান স্বপন কুমার দাস। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগের পরপরই বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষদের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক পদের দায়িত্ব নেন তিনি। ওই রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারও দায়িত্ব পালন করেছেন। ওইসময় থেকেই তার বিরুদ্ধে ঘুষ ও কমিশনের বিনিময়ে বদলি, পদোন্নতি, দায়িত্ব প্রদান, ভবন প্ল্যান অনুমোদন, স্থাপনা উচ্ছেদের অভিযোগ উঠতে থাকে। নিজেকে পরিসংখ্যানবিদ পদে রেখে অবৈধভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ একসঙ্গে চারটি শাখার দায়িত্ব পালন করে একের পর এক অপকর্ম করেন। শুধু দুর্নীতি নয়, তিনি অন্য ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। যেমন– ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বরে সিটি কর্পোরেশনের একজন সহকর্মীকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের ঘটনায় তিনি এজাহারভুক্ত ৬ নম্বর আসামি, ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট বরিশাল সদর ইউএনও ও সিটি কর্পোরেশনের সংঘর্ষের আলোচিত ঘটনায় তিনি এজাহারভুক্ত অন্যতম আসামি। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক বিপ্লবের দায়ের করা ফৌজদার মামলার ২ নম্বর আসামি স্বপন। সব মামলা এখনো চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বপন এক মাস পালিয়ে ছিলেন এবং অফিস করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্বপনের যত সম্পদ
পরিসংখ্যানবিদ স্বপন একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও বর্তমানে কেবল নিজ, স্ত্রী ও ভাইদের নামে বহু স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ গড়েছেন। সম্পদের মধ্যে রয়েছে– গ্রামের বাড়ি বাবুগঞ্জের মাধবপাশায় বহুতল ভবন, মাধবপাশায় মার্কেট নির্মাণ, বরিশালের কালিবাড়ী রোডে গ্রাফিক্সের দোকান, জর্ডন রোডের ফ্ল্যাট, সিটি কর্পোরেশনের ২৫নং ওয়ার্ডের কলাডেমায় ২৫ শতাংশ জমি, কাউনিয়া হাউজিং প্রকল্প-২ এ নিজ নামে প্লট, শ্বশুর বাড়ি উজিরপুরে অর্ধশত একর জমি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া নিজ ও স্ত্রীর নামে ব্যাংক হিসাবে কয়েক কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নারী কেলেঙ্কারি ও নারী কর্মীদের হয়রানিরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
একাধিক পদ ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বপন কুমার দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর্তৃপক্ষ যখন যা দেয়, সেই দায়িত্ব পালন করি। আমি প্রশাসনিক কর্মকর্তা হলেও অবৈধ উচ্ছেদ শাখার প্রধান, মশক নিধন শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমার বিরুদ্ধে যেসব ফৌজদারি মামলা রয়েছে, তা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আর অবৈধ সম্পদের অভিযোগ দুদক খতিয়ে দেখছে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তা হলেও কেন পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে বেতন ও হাজিরাখাতায় সই করছেন– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অফিস বলতে পারবে।
অন্যদিকে, দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, সাবেক মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ বালু ভরাট, ২০২২ সালে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার ব্যানার তৈরির জন্য বরাদ্দ করা ১৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ, মেয়রের ফেসবুক পেজের বুস্টিংয়ের নামে ১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ এবং সাবেক মেয়রের ল্যাপটপ, ড্রোন ক্যামেরা, চেয়ার, টেবিল, মনিটর, আইটি মেশিনসহ অন্য সামগ্রী ক্রয় বাবদ বরাদ্দ করা ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র তলব করে দুদক। তলব করা রেকর্ডপত্রের অধিকাংশ দুদকের পৌঁছেছে বলে জানা যায়। রেকর্ডপত্র ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে।
অনুসন্ধানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোজাহার আলী সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়রসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। নথিপত্র সংগ্রহ ও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য গ্রহণের কাজ চলমান রয়েছে।
আরএম/এসএসএইচ