অদম্য রাফছানের দেশসেরা হয়ে ওঠার গল্প
রাফছান জামান। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি-এইচএসসি পাস করেছেন। দুটিতেই পেয়েছেন গোল্ডেন জিপিএ-৫। ছোটবেলা থেকে শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরে মেধার স্বাক্ষর রাখা রাফছান মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় করেছেন বাজিমাত। ৯৪ দশমিক ২৫ নম্বর পাওয়ায় তার মাথায় উঠেছে দেশসেরা হওয়ার মুকুট।
এ কারণে রোববার (১২ মার্চ) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের কে ব্লকের রাফছানের সুনসান বাসায় হঠাৎ উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মিষ্টি ও ফুল হাতে ছুটে আসছেন আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী, শুভাকাঙ্ক্ষীরা। বাসায় যে আসছেন তাকেই হাসিমুখে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন রাফছানের বাবা এ কে এম সামশুজ্জামান। তার চোখে আজ আনন্দের অশ্রু। খুশিতে তিনি যেন আত্মহারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাফছানের বাবা সিটি গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (শিপিং) হিসেবে কর্মরত। দুই ভাই-বোনের মধ্যে রাফছান দ্বিতীয়। বড় বোন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) আর্কিটেক্ট বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেছেন। তিনি স্নাতকে দ্বিতীয় হয়েছেন।
আরো পড়ুন >> মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম রাফছান জামান
ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড মেধাবী রাফছান। পড়াশোনা ছাড়া তার কোনো ভাবনা ছিল না। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি নিজেও কিছুটা অবাক হয়েছেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, প্রথম আমি নিজেও অবাক হয়েছি। কারণ, এ বছর প্রশ্ন কঠিন হয়েছে। তবে, পরীক্ষা ভালো হয়েছিল। তারপরও এতটা প্রত্যাশা করিনি। মনে হয়েছিল, বাংলাদেশে আমার চেয়ে অনেক ভালো স্টুডেন্ট আছে। যাই হোক, প্রথম হয়ে অনেক ভালো লাগছে।
‘ভালো ফলের জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারপর আমার মা-বাবা। তারা অনেক দোয়া করেছেন। এছাড়া যারা শিক্ষক ছিলেন, তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’
পড়াশোনার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাফছান বলেন, এক্ষেত্রে আমার বিশেষ কিছু ছিল না। কলেজ লাইফের প্রথম থেকে আমি মেডিকেলের যেসব সাবজেক্ট সেগুলো ভালোভাবে পড়েছি। কোনো সময় নষ্ট করিনি। আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি।
দিনে কত ঘণ্টা করে পড়েছেন— জানতে চাইলে রাফছান বলেন, ‘সময় হিসাব করে পড়ালেখা করিনি। তবে, ঘুমানো, খাওয়া-দাওয়া বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাকিটা সময় পড়ালেখা করেছি।’
আরো পড়ুন >> মেডিকেলে প্রথম রাফছানকে নিয়ে ‘টানাটানি’
‘স্মার্টফোনের প্রতি আমার কোনো আসক্তি ছিল না। আমি তো ক্যাডেট কলেজে ছিলাম। সেখানে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করা যায় না। যে কারণে আমি এসব থেকে বেশ দূরে ছিলাম। ক্যাডেট কলেজ থেকে আসার পর যে সময়টা পেয়েছি, আড়াই মাস বা তিন মাস, ওই সময়ে পড়াশোনার ব্যস্ততার কারণে ডিভাইস খুব দরকার ছাড়া ব্যবহার করতাম না। যেটুকু ব্যবহার করেছি পড়ালেখার উদ্দেশ্যে করেছি। কোচিং থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্টস বা ফাইল পাঠানো হতো, এগুলো ডাউনলোড করে পড়েছি। এছাড়া মোবাইলে মডেল টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি।’
বর্তমান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ডিভাইসগুলো চাইলে ভালো কাজে ব্যবহার করা যায়। তবে, বর্তমানে তরুণরা অনেকে ভালোর চেয়ে খারাপ কাজে এসবের ব্যবহার করছে। যে কারণে আমার পরামর্শ হবে স্মার্টফোন ব্যবহার থেকে যতটুকু দূরে থাকা যায় ভালো।’
কোথায় কোচিং করেছেন— জানতে চাইলে রাফছান বলেন, আমি ক্লাসসহ রেটিনার চট্টগ্রাম শাখায় সম্পূর্ণ কোর্স করেছি। উন্মেষ কোচিংয়ে শুধুমাত্র মডেল টেস্ট দিয়েছি।
ভবিষ্যতে কোন বিষয়ে পড়ালেখার ইচ্ছা আছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, এটা অনেক বড় বিষয়। ডাক্তারির মধ্যে অনেক ভালো বিষয় আছে। তবে, আমি নিউরোসায়েন্স বা নিউরোলজি নিয়ে পড়তে চাই।
রাফছানের বাবা এ কে এম সামশুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রেজাল্ট আমি এখনও দেখিনি। সবার কাছ থেকে শুনেছি। আমি অনেক খুশি। আমরা এতটা আশা করিনি। কারণ, পরীক্ষা দিয়ে এসে খুব একটা খুশি ছিল না সে। একটু হতাশ ছিল। তারপরও দেখলাম সে প্রথম হয়েছে।’
‘ছোটবেলা থেকে রাফছান পড়ালেখার বিষয়ে খুব সিরিয়াস ছিল। রেজাল্ট একটু এদিক-সেদিক হলে মন খারাপ করত। যেটা পড়ত খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করত। ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে রেফারেন্স বই পড়ত। যখন সে ক্লাস সেভেনে ছিল তখন থেকে কলেজের বই নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করত। আমরা তখন একটু বকাও দিতাম। ছোটবেলা থেকে সে গণিতে খুব ভালো ছিল এবং সবকিছু মুখে মুখে বলে দিত। এবারও সে গণিতে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে।’
তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে তার মেডিকেলে পড়ার ইচ্ছা ছিল। পড়াশোনার প্রয়োজন ছাড়া স্মার্টফোন কখনও ব্যবহার করেনি সে।
রোববার (১২ মার্চ) দুপুরে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন রাফছান জামান। তার প্রাপ্ত নম্বর ৯৪ দশমিক ২৫। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা দিয়েছেন।
এবারের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮০০ জন। পাস করেছেন ৪৯ হাজার ১৯৫ জন শিক্ষার্থী। পাসের হার ৩৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। পরীক্ষায় সর্বমোট পাসের মধ্যে ছেলে ২০ হাজার ৮১৩ জন ও পাসের হার ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ। মেয়ে পাস করেছেন ২৮ হাজার ৩৮১ জন ও পাসের হার ৫৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
এমআর/টিআই/জেডএস