উপসচিবরা দেন হুমকি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন ‘রোজিনার সঙ্গে কথা নয়’
‘এখন এক কোটি দেব, পরে আরও পাবেন’— শিরোনামের সংবাদ প্রকাশের পর বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছিলেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম। ওই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সচিব রোজিনা ইসলামের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাউকে কথা বলতে নিষেধ করেন। ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য জানান রোজিনার স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠু।
রোজিনাকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দুই উপসচিবের
রোজিনার স্বামী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখন এক কোটি দেব, পরে আরও পাবেন’— এ সংবাদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৬০০ লোক নিয়োগে অনিয়মের তথ্যে যে দুজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল তারাই বেশি হুমকি দিয়েছেন। সংবাদে রোজিনা লিখেছিলেন- ‘‘নিয়োগ পরীক্ষায় যারা ৮০ তে ৭৯ পেয়েছেন, মৌখিক পরীক্ষায় তারা কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ৭৯ পাওয়া ১০ জনের কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চান। তারা কেউই উত্তর দিতে পারেননি। তখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমরা কীভাবে ৭৯ পেলে? তখন তারা (চাকরিপ্রার্থী) বলেন, ‘আমরা একটা লিংক পেয়েছিলাম।’ সাতক্ষীরার দুজন নিয়োগপ্রার্থী স্বীকারও করেন, তারা চাকরির জন্য ১৫ লাখ করে টাকা দিয়েছেন।’’
মনিরুল ইসলাম মিঠু বলেন, ওই সংবাদ প্রকাশের পর থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) শ্রীনিবাস দেবনাথ ও জনপ্রশাসন নিয়োগ কমিটির সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দীপঙ্কর বিশ্বাস তাকে (রোজিনাকে) অনেকবার ফোন করেন। সংবাদ প্রকাশ করতে নিষেধ করেন। ফোন করে হুমকিও দেন। সংবাদ প্রকাশের পর তারা বলেন, ‘নিউজ যে করেছেন, আমরা দেখে নেব।’ আমাকেও আমার আত্মীয়-স্বজন দিয়ে ফোন করে সংবাদ না করার জন্য বলা হয়েছিল।
রোজিনার সোর্সের দেওয়া তথ্যে কী ছিল
মিঠু বলেন, রোববার (১৬ মে) আমরা গ্রাম থেকে টিকা নেওয়ার জন্য ঢাকায় আসি। সোমবার (১৭ মে) দুপুর ২টা ২০ মিনিটে সচিবালয়ে ঢুকে ২টা ২৬ মিনিটে টিকা নিই। টিকা নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আমি রোজিনাকে বলেছি, ‘তুমি টিকা নিয়েছ, বাসায় চল। সে আমাকে বলে, একটা সোর্স আমাকে তথ্য দেবে, আমি সেটা নেব।’
তিনি বলেন, রোজিনাকে তার সোর্স একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে করোনা ভ্যাক্সিন তৈরি করা যে তিনটি কোম্পানিকে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ কোর কমিটি অনুমোদন দিয়েছে, সেই কোম্পানিগুলোর নাম লেখা ছিল। ওই চিঠিটা রোজিনা পড়েনি। সেটি হাতে নিয়েই সে সচিবের সঙ্গে দেখা করতে যায়। ভ্যাক্সিন নিয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে এবং ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য সে সচিবের কাছে যায়। প্রথমে সে সচিবের পিএসের রুমে যায়। পিএস তখন রুমে ছিলেন না। দরজায় থাকা কনস্টেবল মিজানকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, পিএস বাইরে আছেন, আপনি বসেন।
রোজিনা রুমে ঢুকে টেবিলের ওপরে রাখা ডেইলি স্টার পত্রিকাটি হাতে নেন। সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ সেকেন্ড, পত্রিকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই কনস্টেবল মিজান রুমে ঢুকে বলেন, ‘আপনি ফাইলের ছবি তুলেছেন কেন?’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি রোজিনার মোবাইল নিয়ে নেন। কিন্তু মোবাইলে কোনো নথির ছবি ছিল না। ঈদে আমাদের তোলা ব্যক্তিগত ছবি ছিল। আর পুরনো কিছু নিউজের স্ক্রিনশট ছিল। তখন ওই পুলিশ সদস্য বলেন, আপনি ব্যাগে কোনো কাগজ ঢুকিয়েছেন? রোজিনা বলে, ‘না, এখান থেকে কোনো কাগজ নিইনি।’
এরপর অতিরিক্ত সচিব, কনস্টেবল মিজানসহ কয়েকজন তাকে হেনস্তা করা শুরু করেন। এটি চলে বেশ কয়েক ঘণ্টা। দুপুর আড়াইটা থেকে রাত ৯টা, প্রায় নয় ঘণ্টা সেখানে তাকে আটকে রাখা হয়।
চিঠিতে কী ছিল— জানতে চাইলে রোজিনার স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠু বলেন, ‘কোভিড কোর কমিটি তিনটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাক্সিন বাংলাদেশে আনার সুপারিশ করেছে। সেই চিঠিতে শুধুমাত্র সুপারিশ ছিল। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতেই রোজিনা সচিবের কাছে গিয়েছিলেন।’
রোজিনাকে নির্যাতন করে এক নারী, তিন পুরুষ; হাতে জখম
রোজিনার স্বামী বলেন, শারীরিকভাবেও রোজিনাকে নির্যাতন করা হয়েছে। তিন জন পুরুষ ও একজন নারী তাকে নির্যাতন করেন। তিন জন পুরুষের মধ্যে দুজন ছিলেন অতিরিক্ত সচিব। তাদের নাম আমি জানি না। রোজিনার দুই হাতের চামড়া উঠে গেছে, তার গলাও চেপে ধরা হয়। তাকে উপর থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। হাত মচকে ব্যাগও কেড়ে নেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, রোজিনা প্রায় ৫-৬টি রোগে ভুগছে। তার হার্টের সমস্যা, হাইপো-থাইরয়েড, হাই-প্রেসার, ডায়াবেটিকস, ভিটামিন-ডি এর অভাব রয়েছে। প্রতিদিন মোট ১৪টি ওষুধ খায় সে। পুলিশ ঢাকা মেডিকেলে নিতে চাইলেও করোনার কারণে আমরা তাকে সেখানে নিতে বারণ করি।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার (১৭ মে) পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় তাকে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত ৯টার দিকে তাকে সচিবালয় থেকে শাহবাগ থানায় আনা হয়। রাতেই রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
মঙ্গলবার (১৮ মে) বেলা ১১টার একটু পরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তোলা হয় রোজিনাকে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (ওসি, তদন্ত) আরিফুর রহমান সরদার সিএমএম আদালতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২০ মে) তার জামিন শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
বর্তমানে রোজিনা ইসলাম গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।
রোজিনার মামলা তদন্তে গোয়েন্দা পুলিশ
এদিকে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলার তদন্তভার পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে। ডিবির রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, মামলা আমাদের কাছে এসেছে। আমরা তদন্তভার পেয়েছি। যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ মামলার তদন্ত করা হবে।
মামলার বাদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এআর/এসকেডি/এমএআর