মতবিরোধে স্থবির, ৫ মাসেও চূড়ান্ত হয়নি প্রতিবেদন

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আট মাস আর স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের পাঁচ মাস অতিবাহিত হতে চললেও এখনো সংস্কার নিয়ে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি দেশের প্রখ্যাত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ১২ সদস্যের স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। সদস্যদের মতবিরোধ, সুপারিশ প্রদানে গড়িমসিতে জনগণের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার সংস্কারের স্বপ্ন যেন এখনো কাগজে-কলমে বন্দি। নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর সরকার একাধিকবার সময় বাড়ালেও কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। একাধিক সূত্র বলছে, কমিশনের অভ্যন্তরে চলা তীব্র ‘মতানৈক্য’ আর ‘পাণ্ডিত্য’ প্রতিযোগিতায় এখনো চূড়ান্ত হয়নি মূল প্রতিবেদন।
সর্বশেষ গত ২৭ মার্চ মেয়াদ বাড়ানো হয় স্বাস্থ্যসহ পাঁচটি সংস্কার কমিশনের। কমিশনগুলো হলো- স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী, স্থানীয় সরকার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। নতুন সময় অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কাজ করার সময় পাবে এসব কমিশন। সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিবেদন জমা দিলেও স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন ঠিক কবে নাগাদ প্রতিবেদন জমা দেবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও কমিশনের একটি তথ্য বলছে, চলতি মাসের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জোর প্রস্তুতি চলছে।
আরও পড়ুন
জানা গেছে, গত বছরের (২০২৪ সাল) ১৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার কমিশন গঠন করে। জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে এর প্রধান করা হয়। কমিশনের সদস্য করা হয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী, অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার, অধ্যাপক ডা. নায়লা জামান খান, সাবেক সচিব এস এম রেজা, অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক, ডা. আজহারুল ইসলাম খান, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী উমারয়ের আফিফকে।
গত ২৭ মার্চ মেয়াদ বাড়ানো হয় স্বাস্থ্যসহ পাঁচটি সংস্কার কমিশনের। কমিশনগুলো হলো- স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী, স্থানীয় সরকার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। নতুন সময় অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কাজ করার সময় পাবে এসব কমিশন। সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিবেদন জমা দিলেও স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন ঠিক কবে নাগাদ প্রতিবেদন জমা দেবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি
শুরুতে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে কমিশনের সুপারিশ জমা দেওয়ার কথা থাকলেও পরে সময় বাড়িয়ে ৩১ মার্চ করা হয়। কিন্তু সময় গড়ালেও প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় নতুন করে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।
সমন্বয়ের মনোভাব নেই অনেকের মধ্যে
কমিশনের ভেতরের মতবিরোধ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য বলেন, ‘কমিশনের অধিকাংশ সদস্য দেশের স্বাস্থ্য খাতে সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। এ কারণে প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের মতামতকে চূড়ান্ত হিসেবে তুলে ধরছেন। কারও মধ্যে সমন্বয়ের মনোভাব নেই। সবাই চান তার বক্তব্যই শেষ কথা হোক।’
“এই যে ‘বড়ত্ববোধ’, এ কারণে বৈঠকগুলো কার্যকর না হয়ে মূল প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। একাধিক বিষয় নিয়ে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ, যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। সদস্যদের মধ্যে যারা তুলনামূলক জুনিয়র বা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত; তারা একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। অনেক সময় তারা কোনো মতামত দিলেও তা গুরুত্ব পাচ্ছে না বা উপেক্ষিত হচ্ছে।”
‘এভাবে চলতে থাকলে নতুন সময়সীমাতেও সংস্কার প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না’— উল্লেখ করেন ওই সদস্য।
কমিশন এখনো প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি, এটা দুঃখজনক
দেশের প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য বিশ্লেষক ডা. আবু জামিল ফয়সাল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন এখন পর্যন্ত তাদের সংস্কার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি। এটি আমাদের জন্য সবচেয়ে দুঃখের বিষয়। যতটুকু জেনেছি তাদের মধ্যে সংস্কার বিষয়ে মতপার্থক্য থাকাতে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারা প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে পারেনি, এমনকি কবে নাগাদ তা জমা দিতে পারবে সেটিও এখন পর্যন্ত তারা বলতে পারছে না।’
‘কমিশনের সদস্যদের মধ্যে এমন পর্যায়ের মতবিরোধ তৈরি হয়েছে যে, এখানে কেউ কাউকে মানতে পারছেন না। সবাই নিজেকে পণ্ডিত ভাবছেন। ফলে কাজ এগোচ্ছে না, বরং থেমে আছে।’
আরও পড়ুন
ডা. আবু জামিলের মতে, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সংস্কার ছোটখাটো বিষয় নয়। বিশাল একটা কর্মযজ্ঞ। এ খাতে যদি সংস্কার করতে হয় তাহলে অনেক কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে, যা কমিশনের অনেক সদস্যেরই পছন্দ না। তাদের অনেকেই আছেন কাঠামোগত পরিবর্তনে সম্মত নন। তারা চান একটু এদিক-সেদিক করে একটা প্রতিবেদন দাঁড় করাতে।’
‘কমিশনের দু-একজন সদস্য মত দিয়েছিলেন যে, পরিবার পরিকল্পনা আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর— দুটোকে ভেঙে এক করে ফেলা। এটা তো এ খাতে অনেক বড় ধরনের সংস্কার। কিন্তু দুটোকে এক করলে কোন কর্মকর্তা কার অধীনে যাবেন, কার ক্ষমতা কমে যাবে বা কার আদৌ চাকরি থাকবে কি না — এসব নিয়ে বহু সংশয় তৈরি হয়। এগুলো নিয়েই অনেকের সমস্যা।’
‘কমিশনের এ স্থবিরতা নিয়ে সরকারের ভেতরেও অসন্তোষ বাড়ছে’— উল্লেখ করে এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, “শুরুতে বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য খাতকে আলাদা কমিশনের অধীনে এনে মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কমানো হবে। কিন্তু এ প্রস্তাব সামনে আসতেই অনেক আমলা ‘ভয়ের রাজ্যে’ চলে যান। অনেকে মনে করছেন, এতে তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে যাবে, চাকরি নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।”
মতবিরোধ স্বীকার করলেও ‘মিটমাট’ হয়েছে, দাবি
‘মতবিরোধের কথা স্বীকার করলেও সব মিটমাট হয়ে গেছে এবং প্রতিবেদনও প্রায় চূড়ান্ত’— জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল) ও কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি দাবি করেন, ‘প্রতিবেদন প্রায় চূড়ান্ত। এখন সদস্যদের সর্বশেষ পরামর্শ যুক্ত করে রিভিউ করা হচ্ছে। প্রতিবেদন জমা দিইনি মানে এই নয় যে কাজ হয়নি। আমরা চাই সুপারিশগুলো ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই দলিল হোক। এজন্যই আমরা অতিরিক্ত সময় নিচ্ছি।’
আরও পড়ুন
‘মতবিরোধ-মতপার্থক্য থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আমার চিন্তা-চেতনা যে সবসময় অন্যদের সঙ্গে মিলবে, এমনটা কখনো কল্পনাও করা যায় না। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও আমরা শেষ পর্যন্ত একমত হয়েছি এবং প্রতিবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা হয়তো এ মাসের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’
তার মতে, ‘স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি, এটা ঠিক নয়। আমরা জমা দিইনি। আমরা চাচ্ছি, আমাদের সুপারিশটা যেন আগামী দিনে বড় একটা দলিল হয় এবং আমাদের স্বাস্থ্যের ভোক্তা যারা রয়েছেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের সুস্বাস্থ্যও নিশ্চিত করা যায়। আমাদের সার্বিক জনগোষ্ঠী যেন এটার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন। এজন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ পরিশ্রমটা দিচ্ছি।’
সর্বশেষ রিভিউ পর্যায়ে আছে সংস্কার প্রতিবেদন
ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনগুলো দেখছি। এজন্যই আমাদের একটু সময় বেশি লাগছে। আমাদের প্রতিবেদন এখন অলমোস্ট ফাইনাল। সর্বশেষ আমরা একটা রিভিউ পর্যায়ে আছি। সদস্যদের পক্ষ থেকে আর কোনো পরামর্শ যদি আসে তাহলে সেটাও যেন আমরা যুক্ত করতে পারি।’
আরও পড়ুন
এদিকে, মতবিরোধ ও প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারার কারণ জানতে একাধিকবার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে, এর আগে একটি গণমাধ্যমকে তিনি সংস্কার সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে সদস্যদের একাধিক মতের বিষয়টি স্বীকার করেন। বলেন, ‘মতপার্থক্য আছে এবং থাকবেই। তবে, বিলম্বটা হয়েছে কমিশনের কোনো কোনো সদস্য পবিত্র ওমরাহ করতে গিয়েছিলেন। যে কারণে তাদের স্বাক্ষর নেওয়া বাকি ছিল।’
টিআই/এমএআর/