মালদ্বীপে ‘হাইকমিশনার’ নিয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন

ড. মো. নাজমুল ইসলামকে বাংলাদেশ হাইকমিশন, মালে-তে হাইকমিশনার হিসেবে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় পছন্দের ব্যক্তি নির্বাচনে সরকারের এক প্রভাবশালী উপদেষ্টার প্রভাবের কথা শোনা যাচ্ছে। ওই উপদেষ্টার সঙ্গে নাজমুল ইসলামের সখ্যতার বিষয় নিয়েও বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীন ও ভারত— দেশ দুটি এশিয়ার পরাশক্তি, যাদের সম্পর্ক একই সঙ্গে জটিল ও বহুমাত্রিক। তাদের সম্পর্ক বহু বছরের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিনিময়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও আধুনিক যুগে তা সীমান্ত বিরোধ, কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অভাবের কারণে বেশ উত্তপ্ত। সম্প্রতি দেশ দুটির প্রতিযোগিতার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সমুদ্র-নির্ভর মালদ্বীপ। সেখানে হাইকমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তি নির্বাচন, অভিজ্ঞতা, বয়স, ভিনদেশি স্ত্রীসহ নাজমুল ইসলামকে নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো তার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নাজমুল ইসলাম বর্তমানে তুরস্কের আঙ্কারা ইলদিরিম বায়েজিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া অ্যান্ড ইন্দো-প্যাসিফিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। জন্মসূত্রে নোয়াখালীর বাসিন্দা নাজমুলের জন্ম ১৯৯২ সালে। তিনি ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ইলদিরিম বায়েজিদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টর অব ফিলোসফিও (পিএইচডি) সম্পন্ন করেন নাজমুল
জানা যায়, গত ২৭ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আবু সালেহ মো. মাহফুজুল আলমের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে নাজমুল ইসলামকে দুই বছর মেয়াদে মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশনার পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা জানানো হয়। পরবর্তীতে ৩ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মো. আবুল হাসান মৃধার সই করা আরেক অফিস আদেশে নাজমুল ইসলামকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ন্যস্ত করে বাংলাদেশ হাইকমিশন, মালে-তে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
অফিস আদেশে বর্তমান দায়িত্বভার ত্যাগ করে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের জন্য নতুন হাইকমিশনারকে অনুরোধও করা হয়েছে।
ঢাকা-আঙ্কারার নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, নাজমুল ইসলামকে প্রথমে তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করার প্রস্তাব করা হয়। যেখানে বর্তমানে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন পেশাদার ও অভিজ্ঞ কূটনীতিক এম আমানুল হক। তবে, বিসিএস (পররাষ্ট্র ক্যাডার) ১৮তম ব্যাচের পেশাদার এই কূটনীতিককে সরাতে রাজি হয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরে রাষ্ট্রদূতের পদ শূন্য থাকায় মালদ্বীপে নাজমুল ইসলামের নিয়োগ প্রস্তাব (এগ্রিমো) পাঠায় সরকার। মালদ্বীপ সরকার বাংলাদেশের প্রস্তাব গ্রহণও করেছে।
আরও পড়ুন
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা তুরস্ক সফর করেন। ওই সময় সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় নাজমুল ইসলামকে দেখা যায়।
নাজমুল ইসলাম বর্তমানে তুরস্কের আঙ্কারা ইলদিরিম বায়েজিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া অ্যান্ড ইন্দো-প্যাসিফিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। জন্মসূত্রে নোয়াখালীর বাসিন্দা নাজমুলের জন্ম ১৯৯২ সালে। তিনি ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ইলদিরিম বায়েজিদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টর অব ফিলোসফিও (পিএইচডি) সম্পন্ন করেন।
রাষ্ট্রদূত হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স কত হবে— এর কোনো লিখিত বিধান নেই। বাংলাদেশে না হলেও নাজমুল ইসলামের বয়সে বা তার চেয়ে কিছু বেশি বয়সে রাষ্ট্রদূত হওয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে আছে। তবে, যাকে রাষ্ট্রদূতের মতো দায়িত্বশীল দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তিনি এর ভার বহন করার যোগ্যতা রাখেন কি না— সেটাই দেখার বিষয়
আঙ্কারার একটি সূত্র জানায়, পড়াশোনা ও চাকরির সুবাদে প্রায় এক যুগ তুরস্কে আছেন নাজমুল ইসলাম। তিনি তুরস্কে বিয়েও করেছেন। তার স্ত্রী জন্মসূত্রে তুর্কি এবং সেখানে সরকারি চাকরিও করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত বিশেষ বিবেচনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্মান বা অনেক ক্ষেত্রে পুরস্কার হিসেবে দূত হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে, রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে এত কম বয়সী রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার করার নজির নেই। আর পেশাদার কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে প্রশ্নই আসে না। নাজমুলের বয়সী পেশাদার কূটনীতিকেরা সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার হয়ে থাকেন। পেশাদার কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে গ্রেড থ্রি পদে মহাপরিচালক/কনসাল জেনারেল/মিনিস্টার পদে দুই বছরের কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নব্বইয়ের দশকেও পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তারা ১৫ থেকে ১৬ বছর চাকরির পর রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার হওয়ার সুযোগ পেতেন। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পেশাদার কূটনীতিকদের দূত হতে চাকরির বয়স প্রায় ২০ বছর লেগে যাচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এটাও বলছেন, রাষ্ট্রদূত হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স কত হবে— এর কোনো লিখিত বিধান নেই। বাংলাদেশে না হলেও নাজমুলের বয়সে বা তার চেয়ে কিছু বেশি বয়সে রাষ্ট্রদূত হওয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে আছে। তবে, যাকে রাষ্ট্রদূতের মতো দায়িত্বশীল দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তিনি এর ভার বহন করার যোগ্যতা রাখেন কি না— সেটাই দেখার বিষয়।
আরও পড়ুন
এক্ষেত্রে মালদ্বীপে বাংলাদেশের সাবেক দুই হাইকমিশনারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বর্তমান নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ২০২০ হতে ২০২২ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর দেশটিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ। অর্থাৎ নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাজমুল ইসলাম আবুল কালাম আজাদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন।
সরকারের এক দায়িত্বশীল কূটনীতিক বলেন, কৌশলগত বিবেচনায় বিগত বছরগুলোতে মালদ্বীপে সাধারণতে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের হাইকমিশনার করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় মিশনে রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে বিভিন্ন দায়িত্বে সরকার তার পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। তবে, বর্তমানে সরকার যাকে মালদ্বীপে হাইকমিশনার নিয়োগ দিয়েছেন, তাকে সরাসরি হাইকমিশনার না করে অন্য পদে নিয়োগ দেওয়া যেত।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিক চারজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তারা হলেন- পর্তুগালে সাবেক সচিব মাহফুজুল হক, পোল্যান্ডে সাবেক আইজিপি ময়নুল ইসলাম, মেক্সিকোতে সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল (আনসারি) এবং সর্বশেষ মালদ্বীপে নাজমুল ইসলামকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সাধারণত, প্রেষণে মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিতে থাকা বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায় পছন্দের ব্যক্তিদেরও এ পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর মনে করেন, ‘যারা উনাকে (নাজমুল ইসলাম) রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছেন, তারা যদি মনে করেন উনি যোগ্য, তাহলে সেটা করতে পারেন। কিন্তু এটা দেখতে ভালো লাগে না। চূড়ান্তভাবে এটা না করাই ভালো। কারণ, রাষ্ট্রদূত হিসেবে উনি যে দেশেই নিয়োগ পান না কেন, তার কতগুলো দায়িত্ব থাকে। আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাও দেখেছি, এ রকম রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রদূতেরা বুকে নামের ট্যাগ লাগিয়ে মাছের বাজারে হাজির হয়েছেন!’
আরও পড়ুন
‘কাজেই রাজনৈতিক কূটনীতিটা দেশের ভেতরে... যা খুশি আপনি করতে পারেন, কিন্তু বাইরে এটাকে (কূটনীতি) যথেষ্ট সম্মানজনক জায়গায় রাখতে হবে। সেখানে যাদেরই নিয়োগ দেওয়া হোক কেন, সম্মানজনক মানুষ হতে হবে। এখন আমি ইচ্ছা করলাম, যাকে খুশি তাকে নিয়োগ দিলাম— এই ধারণাটা..., বোধ হয় আমি ভালো ধারণা বলব না। পারলে এটা থেকে দূরে থাকাই ভালো।’
অন্যদিকে, হাইকমিশনার নাজমুল ইসলামের সহধর্মিণী বিদেশি নাগরিক হওয়ায় বিষয়টি ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বলছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, এটি দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সহধর্মিণীর বিষয়ে জানতে চাইলে নাজমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টেকে জানান, তার স্ত্রী জন্মসূত্রে তুরস্কের নাগরিক। তিনি দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।
‘হাইকমিশনারের সহধর্মিণী বিদেশি নাগরিক’— বর্তমানে কর্মরত কোনো কোনো কূটনীতিক বিষয়টি ‘দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী বাংলাদেশি হওয়াটাই ভালো। বিশেষ করে নিরাপত্তার জন্য। যদি অন্য দেশের হন..., হন না যে তা নয়। আগে তো কেউ বাংলাদেশি নাগরিক ছাড়া বিয়ে করতে পারতেন না। ২০০৭ সালে এটা পরিবর্তন করা হয়েছে। আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশি হওয়াটাই ভালো।’
আরও পড়ুন
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘সরকার বিভিন্ন জনকে নিয়োগ দিতেই পারে। এটা করা যাবে না, কোথাও লেখাও নেই। বিশেষ বিবেচনায় রাজনৈতিক নিয়োগ হতেই পারে। আর বয়সটা কোনো বিষয় না। তবে, মালদ্বীপ একটা পূর্ণাঙ্গ মিশন। সেখানে সতর্কতার সঙ্গে পাঠানো ভালো। মালদ্বীপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই জটিল। চীন আর ভারতের মাঝখানে..., সেখানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করা খুব সহজ নয়। একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে এই মিশনে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
‘মালদ্বীপের ব্যাপারে উনার (নাজমুল ইসলাম) পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে কি না, আমার জানা নেই। মিশনে আমাদের কূটনীতিক যারা আছেন, তারা উনার সঙ্গে কাজ করতে কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন, সেটা নতুন হাইকমিশনারের ব্যক্তিগত গুনের ওপর নির্ভর করবে।’
এনআই/এমজে/এমএআর/
