যেভাবে প্রাণে বাঁচলেন আফগান নারী মেয়র

জারিফা গাফারি আফগানিস্তানের নির্বাচিত প্রথম নারী মেয়রদের অন্যতম। তালেবানের হাতে কাবুলের পতন তার জন্য ছিল অশনিসংকেত। তালেবানরা যখন কাবুলে ঢুকলো, তিনি তখন বুঝতে পারলেন তার জীবনে এক চরম সংকট হাজির হয়েছে।
এর কয়েকদিন পর তিনি পরিবারসহ পালিয়ে জার্মানিতে চলে যান। তার দেশত্যাগের সেই নাটকীয় ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। তার প্রাণে বেঁচে যাওয়ার গল্প ব্রিটিশ সম্প্রচারমাধ্যম বিবিসির এক অনলাইন প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
উনত্রিশ-বছর বয়সী জারিফা গাফারি ছিলেন একজন জনপ্রিয় নেতা। তিনি হয়ে উঠেছিলেন আফগানিস্তানের নারী অধিকারের একজন কণ্ঠস্বর। তার বিশ্বাস, ঠিক এজন্যই তালেবান তাকে হুমকি বলে মনে করতো। এটাই তার মৃত্যুর মুখে পড়ার অন্যতম কারণ।
ইসলামি আইনকানুনগুলোর যে ব্যাখ্যা তালেবানের কাছে গ্রহণযোগ্য তা ছিল নারীদের ভূমিকা একেবারে সীমিত করে ফেলা। জারিফার মতে, ‘আমার কথার যে শক্তি তা বন্দুকের নলের চেয়েও প্রভাবশালী, সেটা জানতো কট্টর ইসলামপন্থী সশস্ত্রগোষ্ঠী তালেবান।
অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে তালেবানের ক্ষমতা দখলে প্রাণ হারানোর শঙ্কা থাকলেও জারিফা গাফারি প্রথম দিকে ব্যাপারটাকে মেনে নিতে চাননি। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তার সমস্ত আশা ভরসা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তাকে বাড়ি বদলে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তার আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হলো যেদিন তিনি দেখলেন তার খোঁজে তালেবান যোদ্ধারা তার আগের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে এবং সেখানকার একজন নিরাপত্তা কর্মীকে মারধর করছে।
সম্প্রতি কয়েক বছর ধরেই জারিফা গাফারির জন্য নিরাপত্তাহীনতা একটা বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি ময়দান শাহর নামে যে শহরের মেয়র নির্বাচিত হন সেটি ছিল বেশ রক্ষণশীল একটি শহর। আর শহরের অনেকে তালেবান সমর্থক ছিল।
২০১৮ সাল থেকে বেশ কয়েকবার গাফারির প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছিল। গত বছরের শেষদিকেও তার বাবা খুন হওয়ার পর ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। তার বাবা ছিলেন আফগান সামরিক বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন অধিনায়ক।
গাফারি বিশ্বাস করেন, তালেবানই তার বাবাকে হত্যা করেছে। মধ্য আগস্টে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, বেঁচে থাকতে হলে তাকে দেশত্যাগ করতে হবে। ১৮ আগস্ট সপরিবারে একটি গাড়িতে চড়ে কাবুল বিমানবন্দরের দিকে রওনা হন।
এ যাত্রার পুরো সময়টা তিনি গাড়ির সিটের পায়ের কাছে লুকিয়ে ছিলেন। তালেবানের তল্লাশি চৌকিতে প্রতিবার গাড়ি থামানো হলেও তিনি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কারণ কোনোভাবে তালেবানের চোখে ধরা পড়ে গেলে তার প্রাণনাশের শঙ্কা ছিল।
জারিফা গাফারি বিবিসিকে ভয়ার্ত সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে গিয়ে বলেন, ‘যখন বিমানবন্দরে পৌঁছাই, তখন দেখলাম চারিদিকে সব জায়গায় শুধু তালেবান যোদ্ধা। মৃত্যুর মুখে পড়ে ওই সময় আমার পরিচয় গোপন রাখতে খুব কষ্ট করতে হয়েছিল।’
বিমানবন্দরে তুর্কি রাষ্ট্রদূত জারিফা গাফারিকে ইস্তাম্বুলগামী একটি ফ্লাইট উঠিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি জার্মানি চলে যান।
গাফারি বলছেন, ‘যখন আমার বাবার মৃত্যু হয় তখন মনে হয়েছিল জীবনটা ওলটপালট হয়ে গেল। ওই বিমানে ওঠার পর নিজের দেশ ছেড়ে যাওয়ার যে ব্যথা হয়েছিল, সে রকম বেদনা বাবার মৃত্যুর সময়ও পাইনি।’
কাবুলের পতন ছিল ‘জীবনের এক মর্মান্তিক দিন’ ছিল জানিয়ে জারিফা গাফারি বলেন, ‘ এই ব্যথা কোন দিনও যাবে না। কোনদিন যে আমাকে নিজের দেশ ছাড়তে হবে সেটা আমি মোটেও কল্পনা করিনি। জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরে গাফারির জীবন এখন নিরাপদ।
তিনি স্বীকার করেন, কাবুল বিমানবন্দর বিপজ্জনক রূপ নেওয়ার পর যেসব মানুষ সেখানে গেছেন তাদের মধ্যে তিনি অনেক ভাগ্যবান।
তালেবানের শাসনের অধীন আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষজনের জীবনের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে তিনি অন্যান্য আফগান রাজনীতিক ও বিশ্ব নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখার কথাও জানান তিনি।
তালেবানের সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের একে অপরকে বুঝতে হবে।’ বিদেশি সেনা তো আমাদের সাহায্য করবে না। তালেবানের সাথে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার কাজটা আমাদেরই করতে হবে। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য আমি প্রস্তুত।’
এরপরও তালেবানকে বিশ্বাস করেন না গাফারি, বিশেষ করে নারী অধিকারের প্রশ্নে। কারণ সর্বশেষ তালেবান যখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল তখণ তারা ইসলামের এক কঠোর অনুশাসন দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল।
শরীয়া আইনের সেই কঠোর ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে আফগান নারীদের স্কুলে যাওয়া বা কাজে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কাবুল দখলের পর তালেবান বলেছে, ‘নারীরা সমাজের মধ্যে খুবই তৎপর ভূমিকা পালন করবেন। তবে সেটা হতে হবে ইসলামী কাঠামোর মধ্যে।’
এই বক্তব্য নিয়ে সন্দিহান জারিফা গাফারি বলেছেন, ‘তাদের কথার সাথে কাজের কোন মিল নেই। তিনি আশা করেন, আফগানিস্তান নিরাপদ হলে কোন একদিন তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে যাবেন। এটা আমার দেশ। এই দেশ গড়তে আমিও কাজ করেছি। শ্রম দিয়েছি।’
জারিফা গাফারি আরও বলেন, দেশ ছাড়ার সময় আফগানিস্তানের সামান্য একটু মাটিও আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। এই মাটি নিয়েই
আমি একদিন আবার দেশে ফিরে যেতে চাই।’
এএস