এই সরকার আমার কাঙ্ক্ষিত সরকার, উৎখাতের পরিকল্পনা কেন করবো

রমনা মডেল থানার সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও জনতা পার্টি বাংলাদেশের মহাসচিব শওকত মাহমুদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খন্দকার আন্না শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এদিন বেলা ১টা ৫ মিনিটের দিকে তাকে আদালতে তোলা হয়।
এসময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের রমনা জোনাল টিমের পরিদর্শক আখতার মোর্শেদ তাকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর কাইয়ুম হোসেন নয়ন ও হারুন-অর-রশিদ রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন।
শুনানিতে তারা বলেন, হাজারো মানুষের রক্তের বিনিময়ে গত বছরের ৫ আগস্ট আমরা নতুন বাংলাদেশ পাই। এরপর সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারকে উৎখাত করতে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে ষড়যন্ত্র করেন এক মার্কিন নাগরিকসহ এই আসামি। এর পেছনে ভারতের ‘র’সহ একাধিক দেশের গোয়ান্দা সংস্থার হাত রয়েছে। তারা এই সরকারকে ফেলে (উৎখাত) দিয়ে তাদের মনমতো সরকার গঠন করার পরিকল্পনা করে। তবে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চৌকস পদক্ষেপে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এই পরিকল্পনার সঙ্গে আসামি শওকত মাহমুদসহ অন্য আর কারা জড়িত সেজন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। এজন্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছেন। আমরা তার সর্বোচ্চ রিমান্ড প্রার্থনা করছি।
অপরদিকে আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট শফিউজ্জামান তার রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। তিনি আদালতকে জানান, শওকত মাহমুদ গুরুতর অসুস্থতায় ভুগছেন। প্রতিদিন তার ৫টি করে ইনসুলিন নিতে হয়। এখন যদি তাকে থানায় পাঠানো হয় তাহলে পুলিশ সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন নাকি তার চিকিৎসা করবেন। আজকে যে মামলায় তাকে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে সেখানে ঘুরেফিরে এক মার্কিন নাগরিকের নাম আসে। এ মামলার ঘটনার সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র যোগসাজশ নেই। তিনি বাংলাদেশ তথাপি পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ব্যাক্তি যিনি ৫ বার প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। একসময় তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। এসময় এই আইনজীবী শওকত মাহমুদের অসুস্থতার কথা তুলে ধরে আদালতের কাছে তার রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন।
এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন শওকত মাহমুদ। তিনি আদালতকে বলেন, আমি গত ৩৫ বছর থেকে সাংবাদিকতা করি। প্রেসক্লাবের ৬ বার সাধারণ সম্পাদক এবং ৫ বার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দেড় বছর জেলে ছিলাম। সেসময় আমার বিরুদ্ধে ৭০টি মামলা হয়। এই সরকার এসে আমার বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা প্রত্যাহার করেন। এই সরকার আমার কাঙ্ক্ষিত সরকার। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমি কেন এই সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনা করবো। এটা কোন বিশ্বাসযোগ্য কথা হতে পারে না। আমি বিএনপির রাজনীতি করেছি। বিগত সরকারের আমলে আন্দোলনের প্রক্রিয়া নিয়ে দলের (বিএনপি) সঙ্গে মতানৈক্য ঘটে। তাই আমার সদস্যপদ বাতিল করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক মানুষের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক হয়েছে। এর মধ্যে পরিচিত কারও অপকর্মের দায় আমার ওপর বর্তায় না। অসুস্থতার কথা জানিয়ে এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আদালতকে বলেন, আমার ৬টা বাইপাস সার্জারি হয়েছে। জেলে অনেক কষ্ট হচ্ছে। প্রথমে আমাকে জেলখানার হাসপাতালে নেওয়া হলেও পরে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমি বর্তমানে চিকিৎসাবিহীন আছি।
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তার রিমান্ড বাতিলের আবেদন নামঞ্জুর করে যথাযথ বিধি অনুযায়ী তার ৫ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতে অন্য দেশের এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অভিযোগে যে মামলায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই মামলায় শওকত মাহমুদকে গত ৭ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। ওইদিন বিকেলে মালিবাগ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গ্রেপ্তারের পরদিন সোমবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের রমনা জোনাল টিমের পরিদর্শক আখতার মোর্শেদ তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। তবে ওইদিন মামলার মূলনথি না থাকায় রিমান্ডের বিষয়ে শুনানি হয়নি। রিমান্ড আবেদেনর শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, শওকত মাহমুদসহ আরও অজ্ঞাত আসামিরা এনায়েত করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন সময়ে দেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জন-নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করছে। বর্তমান সরকারকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে এবং উচ্চ পদস্থ লোকজন ও ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে গোপনে সভা-সমাবেশ, পরামর্শ করেছে।
আবেদনে আরও বলা হয়, অন্যান্য আসামির সঙ্গে যোগসাজশ করে শওকত মাহমুদ একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চান। এজন্য তিনি কোন কোন দল বা সংগঠনের সঙ্গে গোপনে ‘শলা-পরামর্শ করছেন’, সেসব তথ্য উদঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন।
ঢাকার মিন্টো রোডের মন্ত্রিপাড়ায় গাড়িতে করে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরির সময় গত ১৩ সেপ্টেম্বর সকালে আটক করা হয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীকে। বিকেলে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয় তাকে। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে তাকে রমনা মডেল থানার এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মামলার সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর মিন্টো রোডের মন্ত্রিপাড়া এলাকায় প্রাডো গাড়িতে করে সন্দেহজনক চলাচল করতে দেখা যায় আসামি এনায়েত করিম চৌধুরীকে। এসময় তার গাড়ি থামানো হয় এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে না পারায় তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। তার কাছে পাওয়া ২টি আইনফোন জব্দ করা হয়। প্রাথমিকভাবে তার ফোন বিশ্লেষণ করে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক। তিনি গত ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে নিউইয়র্ক থেকে কাতার এয়ারওয়েজে করে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তিনি বিশেষ একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার চুক্তিভিত্তিক এজেন্ট। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খুব নাজুক অবস্থায় আছেন এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তিনি বর্তমান সরকারকে পরিবর্তন করে নতুন জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের নিমিত্তে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন বলে জানান।
তিনি গত ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর সোনারগাঁও হোটেলে অবস্থান করেন। পরবর্তী সময়ে গুলশানের বর্তমান ঠিকানায় অবস্থান করতে থাকেন। ইতোমধ্যে তিনি সরকারি উচ্চ ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এবং বিভিন্ন বাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন বলে জানান।
তিনি জানান, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমেরিকান সরকার হতাশ। আগামী ২১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় বাতিল করবেন বলে জানান তিনি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে সেনাবাহিনী সমর্থিত নতুন জাতীয় সরকার, অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। নতুন এই সরকারে কারা অংশগ্রহণ করবেন এবং সরকারপ্রধান কে হবেন, তা আমেরিকা নির্ধারণ করে দেবে বলে জানান। তিনি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে সরকারি ও বেসরকারি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বর্তমান অবস্থান এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের তথ্য সংগ্রহ করে তাকে নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা সংস্থার কাছে হস্তান্তর করতেন বলে জানান।
অভিযোগে আরও বলা হয়, আসামি এনায়েত করিম চৌধুরী বর্তমানে বাংলাদেশের বৈধ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করার জন্য অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে এসে জননিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত আছেন, যা ধর্তব্য অপরাধ।
রমনা মডেল থানায় সন্ত্রাস বিরোধ আইনে মামলাটি দায়ের করেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আজিজুল হাকিম।
এদিকে মামলার অভিযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তার সহযোগী এসএম গোলাম মোস্তফা আজাদ, জাতীয় পার্টির রওশনপন্থি অংশের মহাসচিব কাজী মো. মামুনুর রশীদ, সাংবাদিক মো. আজহার আলী সরকার, যুব সংহতির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব রিফাতুল ইসলাম পাভেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন।
এনআর/এসএম
