সাহারা খাতুনের জন্য অশ্রু ঝরে অ্যাডভোকেট লিনার চোখে

‘বাসায়, চেম্বারে সব জায়গায় সাহারা খাতুনের স্মৃতি। এখনও তার মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। তার ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে প্রতিনিয়ত নীরবে অশ্রু ফেলি। স্মৃতিকাতর হয়ে মাঝে মাঝে ছুটে যাই বনানীর কবরস্থানে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলি, আপনি এভাবে চলে গেলেন। এটা ভাবতেও পারি না।’
কাঁদো কাঁদো স্বরে কথাগুলো বলছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকা লিনা। তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। এখন আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহারা খাতুনের সাহচর্যে বেড়ে উঠেছেন। তার কাছেই আইনপেশার হাতেখড়ি। ছিলেন তার বিশেষ রাজনৈতিক কর্মী। সাহারা খাতুন তার মাথার উপর ছায়ার মতো ছিলেন। সাহারা খাতুনের প্রথম মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে অ্যাডভোকেট লিনা তার না বলা কথা ব্যক্ত করেছেন ঢাকা পোস্টের কাছে।
অ্যাডভোকেট লিনা বলেন, ১৯৯৮ সালে সেন্ট্রাল ল কলেজে আওয়ামী আইন ছাত্র পরিষদের রাজনীতি শুরু করি। আমি ওই সংগঠনের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ছিলাম। তখন থেকে সাহারা আপার সাথে পরিচয়। আপা তখন আইনজীবীদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সভাপতি। আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদকও ছিলেন। ২০০৪ সালে আইন পড়া শেষ করে ঢাকা বারে পা দেই। জজকোর্টে তার চেম্বারে জুনিয়র হিসেবে কাজ শুরু করি। সাহারা আপার কাছেই আমার আইন পেশায় হাতেখড়ি। খুব মনে পরে, সেই সময় সাহারা আপা আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক হিসেবে এবং আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সভাপতি হিসেবে নেত্রীর কাছে, দলের কাছে কথা দিয়েছিলেন কোনো রাজনৈতিক মামলায়, কোনো দলীয় নেতাকর্মীর কাছে পারিশ্রমিক নেবেন না। তিনি কখনও নিতেন না। এটা নিয়ে অনেক নেতারা তার প্রতি মনক্ষুণ্নও হতেন। কারণ, সাহারা আপার কারণে তারা টাকা নিতে পারতেন না। আপার পুরো ধ্যানজ্ঞান ছিল আওয়ামী লীগ। আপা জজকোর্টে নির্যাতিত নেতাকর্মীর জন্য যেমন আইনি লড়াই করেছেন, একইসাথে তিনি রাজপথেও আন্দোলন করেছেন। গারদখানায় নিজের টাকা দিয়ে গ্রেফতার নেতাকর্মীদের খাবার কিনে পাঠাতেন। কর্মীবান্ধব এমন নেতা আর খুঁজে পাই না।
কক্সবাজারের মেয়ে লিনা বলেন, আমি আপা বলতাম ঠিকই, কিন্তু তার প্রতি আমার মায়ের মতো শ্রদ্ধা ছিল। ২০০৫ সালে আমার বিয়েতে তিনি কক্সবাজার গিয়েছিলেন। সাহারা আপার কারণেই বড় নেতা-নেত্রীর কাছে যেতে পেরেছি। অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে। ২০০৯ সালে আমার যখন হাইকোর্টে এনরোল হয় তখন তো আপা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার সিদ্ধান্তেই আমি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম স্যারের (বর্তমানে বিচারপতি) জুনিয়র হিসেবে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করি। ২০১৪ সালে আপা মন্ত্রিত্ব থেকে যখন বাদ পড়েন কিছুদিন বিষণ্ণ ছিলেন। বাসায় বসে থাকতেন। তখন আমি আবারও আপাকে বিভিন্নভাবে বলে, অনুরোধ করে হাইকোর্টে আনলাম। তিনি আবার আইনপেশা শুরু করলেন।

কষ্টের স্মৃতি স্মরণ করে অ্যাডভোকেট লিনা বলেন, ২১ আগস্ট যেদিন গ্রেনেড হামলা হলো সেদিন আমরা কয়েকজন আপার গাড়িতে অনুষ্ঠানে যাই। আপা তো বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ট্রাকের উপরের মঞ্চে উঠলেন। ওই দিন আমার খুব জ্বর ছিল। জ্বর দেখে সবাই আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। বাসায় ঢুকে দেখি শরীরে ১০৩ ডিগ্রী দেখি জ্বর। হঠাৎ করে একজন ফোন দিয়ে জানাল সাহারা আপা রক্তাক্ত। তখন চিৎকার করে কান্না করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। অনেক কেঁদেছিলাম। আপার প্রেম ছিল আওয়ামী লীগ, প্রেম ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি। সব সময় মনে হয়, আমার আপন মানুষ কেউ যদি দুনিয়া থেকে চলে গিয়ে থাকেন সেটা সাহারা আপা গেছেন।
তিনি আরও বলেন, সাহারা আপা নেই। দ্বিতীয় সাহারা খাতুন কখনও আসবে না। কিন্তু আমি মনে করি সাহারা আপার আদর্শ মরেনি। তার আদর্শ, শ্রম, ত্যাগ কখনও বৃথা যাবে না। তিনি আমাদের মুজিব আদর্শের যে কর্মীগুলো তৈরি করে গেছেন তারা তো নিভে যাবেন না। তিনি আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কর্মী সৃষ্টি করে গেছেন। যারা নতুনদের জয়বাংলার আদর্শে দীক্ষিত করবে। কী পেলাম, কী পেলাম না- এটা ভাবি না। আমরা আওয়ামী লীগ করে যাব, আওয়ামী লীগকে দিয়ে যাব। এটাই আমার প্রিয় সাহারা আপার শিক্ষা।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৯ জুলাই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন (৭৭) মারা যান। থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এমএইচডি/এইচকে
