দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও একাধিক হত্যাকারী জড়িত থাকার সন্দেহ
রাজধানীর হাজারীবাগে তানিয়া আক্তার (৩৫) হত্যাকাণ্ডের পর তার মোবাইল ফোন, হ্যান্ড ব্যাগ ও চাবি নিয়ে গেছে হত্যাকারীরা। তার রুমের সবকিছু স্বাভাবিক পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে। দেখে বোঝোর উপায় নেই এখানে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তানিয়ার গলাকাটা মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল ওয়াশরুমে। এমনভাবে রাখা ছিল যাতে সব রক্ত পানি যাওয়ার জায়গা দিয়ে বের হয়ে যেতে পার। হত্যাকাণ্ডের এসব আলামত দেখে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও পুলিশের ধারণা, এটি দীর্ঘদিনের সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বাড়ির মালিক মোস্তাকিম আহমেদ এলাইম শাহিনকে গ্রেপ্তারের পর ২ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি।
তানিয়া হত্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডে পেশাদার লোকজন জড়িত থাকতে পারে। হুট করে তানিয়াকে হত্যা করা হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরে সু-পরিকল্পিতভাবে পরিকল্পনা করে হত্যা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে যেসব আলামত পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের পর মরদেহের অবস্থান ও তানিয়ার কক্ষটি দেখে মনে হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডটির সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে। ভিকটিমের জামা কাপড়ও ঠিকঠাক ছিল। ভিকটিম ঘটনার দিন হাজারীবাগের মায়ের বাসা থেকে যেভাবে বের হয়ে এসেছিল ঠিক সেভাবে তার মরদেহ পাওয়া গেছে। এছাড়া রুমটি ভেতর থেকে লক করা ছিল। হত্যার পর ভিকটিমের ফোন, ব্যাগ ও চাবি নিয়ে যায় হত্যাকারীরা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ইহসানুল ফিরদাউস ঢাকা পোস্টকে বলেন, তানিয়া হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে পর্যাপ্ত তথ্য ও প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। আমরা বিভিন্ন বিষয় মিলিয়ে দেখছি। নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন হত্যাকাণ্ডে কতজন লোক ছিল। তবে হত্যাকাণ্ডে একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে।
কে এই শাহীন
তানিয়া হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত একমাত্র গ্রেপ্তার ব্যক্তি হলেন যে বাড়িতে হত্যাকাণ্ডটি সেই বাড়ির মালিক মোস্তাকিম আহমেদ এলাইম শাহিন। শাহিন বর্তমানে দুই দিনের রিমান্ডে রয়েছে হাজারীবাগ থানা পুলিশের কাছে। তানিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে পরিচয় থাকা সূত্র ধরে শাহিনকে সন্দেহভাজন হত্যাকারী হিসেবে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু স্বীকার করেনি। শাহীন স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা বলে জানা গেছে। তবে তার পদ-পদবীর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাজারীবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নিকলেশ চন্দ্র কর পলাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৮ সাল থেকে শাহিনের সঙ্গে পরিচয় তানিয়ার। তানিয়ার স্বামী থাকা সত্ত্বেও সে শাহিনের বাড়িতে একা ভাড়া থাকতেন। ওই বাসায় শাহিনের যাতায়াত ছিল। ঘটনার দিন শাহিনের সঙ্গে তানিয়ার একাধিকবার ফোনে কথা হয়েছে। ফোনে কথা বলার তথ্য আমরা হাতে পেয়েছি। এসব বিষয় বিবেচনা করে শাহিনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে সে এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেনি।
তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনায় এই হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকারও কিছু আলামত পাওয়া যাচ্ছে।
শাহিনের সঙ্গে যেভাবে পরিচয় তানিয়ার
তানিয়ার পরিবার সূত্রে জানা যায়, তানিয়া হাজারীবাগ ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে শাহিনও ১৪ নম্বর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। ২০১৮ সালে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচনে কাজ করতে গিয়ে তানিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে তখন থেকে পরিচয় বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তানিয়ার পরিবারের সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে শাহিনের। শাহিন তানিয়ার মাকে খালা বলে ডাকতো। এই পরিচয়ের সূত্র ধরে শাহিনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল তানিয়াদের হাজারীবাগের বাসায়। তানিয়ার মা-ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শাহিনের মাধ্যমে তানিয়ার মা বিভিন্ন সময় স্থানীয় লোকজনকে রেশন কার্ড পাইয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করতেন। এসব পরিচয়ের সূত্র ধরে তানিয়া চলতি মাসে জানুয়ারি মাসে হাজারীবাগ ১৭/১ মিতালি রোডে শাহিনের বাড়ির ৭ম তলায় ভাড়া বাসায় ওঠেন।
কাউকে সন্দেহ করছে না পরিবার, প্রমাণের অপেক্ষায় পুলিশ
তানিয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন পর্যন্ত কাউকে সন্দেহ করতে পারছে না তার পরিবার। এমন কী গ্রেপ্তার শাহিনকেও সন্দেহ করতে পারছে না। পরিবার চাইছে পুলিশ তদন্ত করে আসল রহস্য উদঘাটন করুক।
এ বিষয়ে তানিয়ার ভাই ও হত্যা মামলার বাদী তন্ময় হাসান নীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ এখন পর্যন্ত হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে পারেনি। প্রকৃত হত্যাকারীকে প্রমাণসহ উপস্থাপন করার আগ পর্যন্ত আমরা কাউকে সন্দেহ করতে পারছি না। গ্রেপ্তার শাহিনকেও আমরা ওইভাবে সন্দেহ করতে পারছি না, যখন পর্যন্ত পুলিশ প্রমাণসহ হত্যাকাণ্ডের আসল রহস্য উদঘাটন না করতে পারছে। আপুর সঙ্গে যারা যারা পরিচিত ছিল তাদের মধ্যে পুলিশ কাদের সন্দেহ করছে এবং আসল রহস্য উদঘাটন করার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করে কী তথ্য পায়, সেটার জন্য অপেক্ষা করছি আমরা।
উল্লেখ্য, গত ২১ জানুয়ারি দুপুরে হাজারীবাগ ১৭/১ মিতালি রোডের বাসার সপ্তম তলার কক্ষের ভেতরের ওয়াশরুম থেকে তানিয়ার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তানিয়ার মরদেহের গলায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ ঘটনায় সোমবার (২২ জানুয়ারি) তানিয়ার ভাই তন্ময় হাসান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হাজারীবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলায় এজাহার সূত্রে জানা যায়, হাজারীবাগ থানাধীন ১৭/১ মিতালি রোডের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি থেকে বসবাস করছিলেন তানিয়া। ওই ফ্ল্যাটে দুটি রুমের অপরটিতে ইতি নামে একজন সাবলেট হিসেবে ভাড়া থাকেন। যদিও তানিয়ার মায়ের বাসা রয়েছে হাজারীবাগে।
২০১৭ সালে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানা এলাকার প্রবাসী আজিজুর রহিমের সঙ্গে বিয়ে হয় তানিয়ার। বিয়ের এতো বছরেও তাদের কোনো সন্তান ছিল না। তানিয়া গত ১৯ জানুয়ারি হাজারীবাগে তার ভাইয়ের বাসায় যান। ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসা থেকে টিফিন বক্সে করে রাতের খাবার নিয়ে নিজের বাসায় চলে যান। পরদিন তার মোবাইল ফোনে পরিবারের সদস্যরা একাধিকবার কল করলেও বন্ধ পায়। শেষে পরে ২১ জানুয়ারি তানিয়ার বাসায় গিয়ে তারা ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া না পেয়ে হাজারীবাগ থানা পুলিশকে খবর দেয় তার ভাই। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মিস্ত্রি ডেকে রুমের দরজার তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পায় ওয়াশরুমে তানিয়ার গলাকাটা রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে আছে।
এমএসি/এসএম