মিরপুরে ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ-দ্বন্দ্বের বলি’ কারবারি পেপার সানি

পা গামছায় বাঁধা, হাতে ছিল হাতকড়া পড়ানো। মঙ্গলবার (১০ জুন) এমন অবস্থায় পল্লবী থানাধীন সেকশন-১১ এর বি ব্লকের, মসজিদের সামনে গলাকাটা অবস্থায় পড়েছিল রাকিবুল হাসান সানি ওরফে পেপার সানির (২৫) মরদেহ। পরে স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ৯৯৯ এর মাধ্যমে দেওয়া খবরে ঘটনাস্থল থেকে পেপার সানির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
একসময় পেপার বিক্রি করতেন বলে রাকিবুল হাসান সানি পরিচিতি পায় পেপার সানি নামে। তবে বেশিদিন পেপার বিক্রি করেননি, সানি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। সর্বশেষ গত কয়েক বছরে পল্লবী এলাকার কিশোর গ্যাং পরিচালনা ও মাদক কারবারের অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠা পেপার সানিকে খুন করলো কারা?
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ বলছে, পেপার সানির বিরুদ্ধে পল্লবী থানাসহ মিরপুরের বিভিন্ন থানায় মাদকসহ একাধিক মামলা রয়েছে। স্থানীয় থানা পুলিশের তালিকায় মাদক কারবারি ছাড়াও পেপার সানির পরিচয় সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ-দ্বন্দ্বের বলি হয়েছে পেপার সানি। প্রতিপক্ষরাই তাকে খুন করে থাকতে পারে সন্দেহে তদন্ত করছে পুলিশ।
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মঙ্গলবার (১০ জুন) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খবর পেয়ে পল্লবী থানাধীন মিল্লাত ক্যাম্প থেকে নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে পল্লবী থানা পুলিশ। মরদেহের সুরতহালে দেখা গেছে, নিহত যুবক শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পরিহিত ছিল। পা ছিল গামছায় বাঁধা। হাতে হাতকড়া পড়া। গলা ছিল কাটা ও রক্তাক্ত।
নিহত সানির বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মাদকসহ পাঁচটি মামলা রয়েছে। মাদক নাকি অন্য কোনো দ্বন্দ্বের কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় নিহতের মা রোজিনা বেগম বাদী হয়ে গতরাতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার উল্লিখিত আসামি ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
পল্লবী থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দায়ের করা মামলায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সবাই মাদক কারবারি। উল্লিখিত আসামিরা হলেন— রুবেল ওরফে লেংড়া রুবেল (৩৫), বোমা কাল্লু (৩৪) ও স্বপন (২২)। একই মামলায় আরও দুজনকে সহযোগী আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন, জিন্দা (২৩) ও টান আকাশ (২৪)। তারাও পুলিশের অপরাধীর তালিকায় মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী।
মামলায় বাদীর অভিযোগ, রাকিবুল হাসান সানি ওরফে পেপার সানি ফুটপাতে কাপড়ের দোকান ও অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। আসামিরা তার প্রতিবেশী। আসামিরা সবাই নিহত পেপার সানি ও পরিবারের পূর্ব পরিচিত। তারা বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে শত্রুতা পোষণ করে আসছিল।
রাতে পেপার সানিকে ডেকে নিয়েছিল ল্যাংড়া রুবেল
মা রোজিনা বেগমের দাবি, শত্রুতা ও প্রাণনাশের হুমকির কারণে পেপার সানি স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকে সাভারে। ঈদুল আজহার রাতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে মিরপুরের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন পেপার সানি। খাওয়া-দাওয়া করে ফিরেও যান।
তিনি বলেন, কিন্তু গত ৯ জুন রাতে মামলার ১ নম্বর আসামি ল্যাংড়া রুবেল ফোন করে মিরপুরে আসতে বলেছিল সানিকে। রাত ১১টার সময় স্বপন মোবাইল ফোনে কল দিয়ে ল্যাংড়া রুবেলের কথা বলে মিরপুর সাড়ে ১১-তে যেতে বলে। তখন আর কে কে আছে জানতে চাইলে স্বপন বলেছিলেন রুবেল ও কাল্লু। কথা আছে বলে আসতে বলে। সরল বিশ্বাসে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি পেপার সানি। পরে স্থানীয় ও পুলিশের মাধ্যমে জানতে পারি আমার ছেলের হাত পা বাঁধা অবস্থায় গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি দাবি করে আরও বলেন, পরস্পর যোগসাজশে পূর্ব শত্রুতার জেরে যারা ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে তারা সবাই মাদক ব্যবসায়ী। সারারাত ধরে এলাকায় মাইক্রোবাসে করে ঘুরিয়ে হাত পিছনে নিয়ে হাতকড়া লাগিয়ে এবং পা গামছা দিয়ে বেধে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করেছে। আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১৬ মার্চ এলাকায় মাদক ও আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে রাব্বি গ্রুপের হামলায় পেপার সানি গ্রুপের ফয়সাল নিহত হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হলে দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল। মাদকের টাকা ভাগাভাগি ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ফয়সালকে খুন হয় বলে সেসময় জানিয়েছিল পুলিশ। ওই ঘটনার পর অনেকটা আড়ালে থেকেই মাদক কারবার পরিচালনা করে আসছিল পেপার সানি।
মামলা হলেও এবং ঘটনার দুদিন অতিবাহিত হলেও পেপার সানিকে হত্যায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের ধারণা, ৫ আগস্টে বিভিন্ন থানা লুটের সময় লুট হওয়া হ্যান্ডকাফ হয়ত ব্যবহার করা হয়েছে পেপার সানি হত্যার সময়।
মাদক-আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে খুন পেপার সানি-ধারণা পুলিশের
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিরপুরের কোনো একটি জায়গায় হত্যার পর মাইক্রোবাসে করে ঘটনাস্থলে ফেলে যায়। পুলিশ সোর্স ও তদন্ত মতে, মাদককে কেন্দ্র করে হত্যার শিকার পেপার সানি। এই ঘটনায় জড়িতদের শনাক্তসহ মামলায় উল্লিখিত আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।
জেইউ/এমএন