বন্ধুত্বের ফাঁদে দুবাইয়ে পাচারের শিকার তরুণীর কান্না

প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে দুবাই প্রবাসী অপু। তার এ কাজে বাংলাদেশে সহযোগিতা করে শামীমা নামে আরেক তরুণী। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে দেশে আসে অপু। টার্গেট করা নারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উচ্চ বেতনে দুবাইয়ে চাকরির প্রলোভন দেখায়। প্রলোভনে রাজি হলে চক্রের প্রধান কামাল নিজ খরচে বিভিন্ন মেয়েদের ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই নিয়ে যায়। এরপরই তাদের জিম্মি করে অসামাজিক কাজে বাধ্য করা হয়।
গত এপ্রিলে এভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় সূত্রে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভনে পড়ে পাচারের শিকার হন নারায়ণগঞ্জের এক তরুণী (১৯)। অপু তাকে নিজ খরচে দুবাই নিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা সব কেড়ে নেয়। এরপর একটি হোটেলে অসামাজিক কাজে জড়াতে বাধ্য করে। সেখানে তার ওপর চলে নির্যাতন।
এরমধ্যে ওই তরুণী গোপনে মাকে ফোন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। নিজের জিম্মিদশা ও অসামাজিক কার্যক্রমে জোরপূর্বক বাধ্য করা ও নির্যাতনের বর্ণনা দেন। মেয়ের শোকে কাতর মা অভিযোগ করেন র্যাব-৩ এর কাছে। র্যাবও ফোনে ওই তরুণীর আহাজারি শোনে। কিন্তু দুবাইয়ের ঠিক কোন হোটেলে জিম্মি তাও জানে না ওই তরুণী।
তবে ওই তরুণীকে পাচারের কাজে সহযোগিতা করায় রাজধানীর ডেমরা, কেরানীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ এলাকা থেকে নারী পাচারকারী চক্রের ৪ সদস্যকে আটক করেছে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব ৩ এর একটি দল পৃথক অভিযানে সোমবার (২ আগস্ট) দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে তাদের আটক করে।
আটক নারী পাচারকারী চক্রের সদস্যরা হলেন- নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের মোছা. শামীমা আক্তার (২১), সুনামগঞ্জ ছাতকের শংকর বিশ্বাস (২৫), মানিকগঞ্জের বংখুরী এলাকার শেখ হানিফ মিয়া (২৮) ও জুয়েল হোসাইন (২৯)।
এ ব্যাপারে র্যাব-৩ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বীণা রানি দাস জানান, আটক শামীমা পাচারের শিকার ভুক্তভোগীর বান্ধবী। পাচারকারী চক্রের সদস্য শামীমার সঙ্গে দুবাই প্রবাসী অপুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব হয়। সে সুবাদে ভুক্তভোগী তরুণীর সঙ্গেও পরিচয় যোগাযোগ হয়। অপু গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে বেড়াতে এসে ভুক্তভোগী ও পাচারকারী শামীমার সঙ্গে সাইনবোর্ড নারায়ণগঞ্জ এলাকায় দেখা করে।

অপু তখন ভুক্তভোগী তরুণীকে দুবাই শপিংমলে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখায়। প্রস্তাবে রাজি হলে অপু ভিকটিমকে তার পরিবারের সদ্যদের কাছে বিষয়টি গোপন রাখতে বলে। শামীমা গোপনে ভিকটিমের পাসপোর্ট তৈরি করে দেয়।
এরপর অপু দুবাই প্রবাসী চক্রের প্রধান কুমিল্লার লাকসামের কামাল হোসাইনের মোবাইল নম্বর ভিকটিমকে দেয়। কামাল ভিকটিমকে পল্টনের মেসার্স মেহরাব এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল এজেন্ট টিকিট ম্যানেজার শেখ হানিফ মিয়ার কাছে পাসপোর্ট জমা দিতে বলে।
আটক জুয়েল হোসাইন দুবাই প্রবাসী। তিনি আটক শেখ হানিফ মিয়ার ঘনিষ্ট বন্ধু। দুবাই প্রবাসী কামাল আটক জুয়েলের ঘনিষ্ট বন্ধু। ঘটনার সময় জুয়েল দুবাই ছিল। সে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসে। কামাল দুবাই থেকে জুয়েলের মাধ্যমে ভিকটিমের দুবাই যাওয়ার খরচ বাবদ ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা হানিফের কাছে পাঠায়।
বীণা রানি দাস জানান, হানিফ ও তার কর্মচারী শংকর ভিকটিমের তিন মাস মেয়াদি দুবাইয়ের ট্যুরিস্ট ভিসা এবং প্নেনের টিকিট করে দেয়। এরপর কামাল ভিকটিমকে জানায় যে, তার ভিসা এবং টিকিট তৈরি হয়ে গেছে। ২৮ এপ্রিল দুপুরে হানিফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। ভিকটিম তার মা ও বোনকে কিছু না জানিয়ে গত ৩০ এপ্রিল রাতে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা করে। দুবাই বিমান বন্দরে পৌঁছলে কামাল ভিকটিমকে তার বাসায় নিয়ে যায় এবং তার পাসপোর্ট কেড়ে নেয়। তারপর কামাল ভিকটিমকে জোরপূর্বক অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য করে। অবাধ্য হলে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ভিকটিম তার মায়ের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে তাকে উদ্ধার করার আকুতি জানায়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও জানান, প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে আরও ৫/৬ তরুণীকে দুবাইয়ে পাচার করেছে কামাল-অপু চক্র। তাদের প্রত্যেককে নিজ খরচায় বিভিন্ন মেয়েদের ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই নিয়ে হোটেলে জিম্মি করে অসামাজিক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। আটকদের নামে পল্টন থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেখানে জিম্মিদের উদ্ধার ও চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দুবাই বৈদেশিক দূতাবাসে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
জেইউ/জেডএস