ডিএনএ রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে পুলিশ

মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিনের মৃত্যুর ১৪ দিনের মাথায় এসে তদন্তের ইতি টানতে যাচ্ছে পুলিশ। ডিএনএ রিপোর্ট ও ময়নাতদন্ত (পিএম) প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে তারা, সেটি পাওয়া গেলেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন যাবে আদালতে। তবে এ প্রতিবেদন আসতে যে সময় লাগতে পারে তার স্পষ্ট ইঙ্গিতও মিলেছে।
কলাবাগান থানা পুলিশ স্বীকার করছে, আলোচিত এ ঘটনার সব রহস্যের উদঘাটন হয়নি। তারা বলছে, কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদন প্রয়োজন। এগুলো পাওয়া গেলে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে। তবে তথ্যপ্রমাণ ও আলামত এখনও পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে ইতোমধ্যে প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়েছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, তদন্তে ইতোমধ্যে দিহান ও আনুশকার কল রেকর্ড, শর্ট ম্যাসেজে কথোপকথন, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কথোপকথন নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে। এছাড়াও ঘটনার আগের দিন তাদের দুইজনের মধ্যে ফেসবুকে কী কথা হয়েছিল সেগুলোও পুলিশের হাতে রয়েছে। সেগুলোও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কলাবাগান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আ ফ ম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমরা এখন অপেক্ষা করছি সিআইডির ডিএনএ পরীক্ষার ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের। এই দুইটি তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেই মামলার সকল রহস্যের উত্তর পাওয়া যাবে। এছাড়া প্রতিবেদন কাছে এলে দ্রুত চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে।’
আমাদের তদন্তে এখন পর্যন্ত দিহান ছাড়া এ ঘটনায় কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আ ফ ম আসাদুজ্জামান
তদন্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, দিহানের ও আনুশকার ম্যাসেঞ্জারের কথোপকথন, দিহান ও তার তিন বন্ধু মোবাইল ফোনের ফরেনসিক টেস্ট, বাসা ও আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, দিহানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং দারোয়ান দুলাল মিয়ার সাক্ষ্য যাচাই-বাছাই করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে।
ধর্ষণ বা হত্যায় দিহানের তিন বন্ধুর সংশ্লিষ্টতা মেলেনি
পুলিশ বলছে, পুলিশের কাছে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ ও আলামতে দিহান ছাড়া অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে পরিষ্কার হবে দিহান ছাড়া এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত ছিল কি-না।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের তদন্তে এখন পর্যন্ত দিহান ছাড়া এ ঘটনায় কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেসনিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন আসতে আরও মাসখানেক সময় লাগতে পারে। মামলাটি দেশব্যাপী আলোচিত হলেও নির্দিষ্ট সময় ছাড়া তারা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা দিতে পারবে না।
ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, আমরা ভিসেরা পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষা করছি। এই ফলাফল আসতে মাসখানেক সময় লাগবে। আর এর পরেই আমরা পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো। এছাড়া ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা আমরা সিআইডিতে পাঠিয়েছি। এই পরীক্ষার ফলাফল কবে আসবে তা সিআইডি ভালো বলতে পারবে। তবে সাধারণত ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল আসতে অনেক সময় লাগে। তবে ঘটনাটি আলোচিত হওয়ায় ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দ্রুত আসতে পারে বলে আশা করা যায়।
এদিকে আনুশকার পরিবারের তরফ থেকে বরাবরই যে দাবি করা হচ্ছে যে, ঘটনার দিন আনুশকার সম্মতি ছাড়াই তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল দিহান, তার উল্টো চিত্র উঠে আসছে পুলিশের তদন্তে। দিহান ও আনুশকার ম্যাসেঞ্জারের কথোপকথন দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে যে তাদের মধ্যে আগে থেকেই রিচয় ছিল এবং ঘটনার আগের দিনের ম্যাসেঞ্জারের কথোপকথন দেখলে এটা স্পষ্ট যে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে ওইদিন আনুশকা দিহানের বাসায় গিয়েছিল।
তদন্তে সঠিক তথ্য উঠে আসবে, আশা আনুশকার বাবার
আনুশকার বাবা আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পুলিশের ওপর আস্থা রয়েছে। তদন্তে সঠিক তথ্য উঠে আসবে বলে আমরা আশাবাদী। ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার মেয়েকে শুধু দিহান নয়, তার তিন বন্ধু মিলে পাশবিক নির্যাতন করে যে হত্যা করেছে সে বিষয়টি এই তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসবে বলে আশাবাদী। আর যদি তা কোনো কারণে না হয়, তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।
অন্যদিকে শুরু থেকে দিহানের পরিবার দাবি করে আসছে দিহান ইচ্ছা করে আনুশকাকে হত্যা করেনি। তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক পরস্পরের সম্মতিতে হয়েছে। কিন্তু শারীরিক সম্পর্কের পর দুর্ঘটনাবশত আনুশকার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে। দিহানের মা গণমাধ্যমে পাঠানো খোলা চিঠিতে এসব কথা বলেছেন ।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ধর্ষণের উদ্দেশ্যে নয়, একান্তে সময় কাটাতে বাসায় আনুশকাকে ডেকেছিল দিহান। উভয়ের বয়স কম। একজন নাবালিকা এবং আমার ছেলেরও বয়স ১৮ বছর ৭ মাস অর্থাৎ কিশোর। আবেগের বশে উভয়েই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল এবং অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে। পরবর্তীতে যা হয়েছে তা নিতান্তই দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে। আমার ছেলে ধর্ষক বা হত্যাকারী হলে সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করত কিন্তু সে তা করেনি। সে নিজে গাড়ি করে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। মেয়েটির মাকে ফোন করেছে, পুলিশের কাছে ঘটনা স্বীকার করেছে। আমার ছেলে যদি মেয়েটির সঙ্গে অন্যায় করে তাহলে একজন নারী হিসেবে আমিও আমার ছেলের যথাযথ বিচার হোক সেটা চাই।
দিহানের মা আরও বলছেন, কিন্তু মেয়েটির ইচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল কি-না এবং একমাত্র শারীরিক সম্পর্কের কারণেই রক্তক্ষরণ ও মৃত্যু হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে পুলিশ প্রশাসনের ওপর আমি বিশ্বাস রাখতে চাই এবং বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রাখতে চাই। বিচারের আগে আমার ছেলেকে ধর্ষক বা হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত না করার জন্য সমাজের সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
দিহান ও তার বন্ধুদের নিয়ে আনুশকার পরিবারের যত অভিযোগ
শুরু থেকেই আনুশকার মৃত্যুর জন্য দিহানকে দায়ী করে আসছে তার পরিবার। ঘটনার একদিন পর থেকে এর সঙ্গে দিহানের তিন বন্ধুকেও দায়ী করে আসছে আনুশকার পরিবার। মামলার এজাহারেও দিহানকেই অভিযুক্ত করেছে আনুশকার পরিবার।
এ বিষয়ে আনুশকার বাবা বলেন, দিহান শুধু এ ঘটনায় একা জড়িত নয়। তার তিন বন্ধুও এ ঘটনায় জড়িত। আমার ধারণা দিহান আর তার তিন বন্ধু মিলে আনুশকাকে জোর করে বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে অমানবিক নির্যাতন করে মেরে ফেলে। পরে ঘটনা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে তারা আমার মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া আমার মেয়েকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া ঢামেক হাসপাতালের অনেক পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে, একজনে এই কাজটা করেনি। তাকে নানানভাবে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এখন এসে বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি দিহানের তিন বন্ধুও জড়িত আছে। তাই তাদের প্রতি আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। এছাড়া দিহানের তিন বন্ধুর মধ্যে একজনের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। সে কোথা থেকে এসেছে এবং কেন এসেছে। কিন্তু এখন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
গত ১০ জানুয়ারি এ ঘটনায় চাঞ্চল্যকর এক তথ্য দেন আনুশকার বাবা। তিনি দাবি করেন, ঘটনার দিন আনুশকা দিহান ও তার পরিবারের নির্যাতন থেকে বাঁচতে তাকে ফোন করেছিল। কিন্তু তিনি ফোনটি ধরতে পারেননি।
আনুশকার বাবা গত ১০ জানুয়ারি ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, ঘটনার দিন দুপুর ১২টা ১৯ মিনিটে আনুশকা আমাকে ফোন দেয় তারা মোবাইল থেকে। তখন আমি একটা মিটিংয়ে থাকায় কল কেটে দেই। পরে নানা ব্যস্ততার কারণে তাকে কলব্যাকও করতে পারিনি। আমার এখন মনে হচ্ছে আনুশকা যখন কোচিংয়ে যাচ্ছিল তখন হয়তো দিহান তিন বন্ধুকে নিয়ে তাকে রাস্তায় বাঁধা দিচ্ছিল। নয়তো আনুশকাকে যখন তারা নির্যাতন করছিল, তখন সে আমাকে ফোন দেয়। ফোনটা না ধরতে পারায় ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। আমি যদি ফোনটা রিসিভ করতে পারতাম, তাহলে আমার মেয়ে তাকে নির্যাতন বা রাস্তায় বাঁধা দেওয়ার কথা বলত। তখন আমি দ্রুত ব্যবস্থা নিলে ঘটনা এত দূর আসতো না। আর আমি মিরপুরে ছিলাম, এমন কিছু জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতে পারতাম। আমরা মেয়েকে তারা প্রেসারাইজড করেছে, না হলে আমার মেয়ের ওইদিকে যাওয়ার কথা না। আমি এসব কথা পুলিশকেও জানিয়েছি।
ঘটনার শুরু থেকে শেষ
গত ৭ জানুয়ারি দুপুরে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তাকে আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রক্তাক্ত অবস্থায়। নিয়ে গিয়েছিলেন ইফতেখার ফারদিন দিহান। পরবর্তীতে জানা যায়, আনুশকা দিহানের বাসাতেই ছিলেন। সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এ ঘটনায় দিহান ও তার তিন বন্ধুকে আটক করে পুলিশ।
ঘটনার দিন রাতে কালবাগান থানায় দিহানকে আসামি করে মামলা করেন আনুশকার বাবা মো. আল আমিন। আনুশকাকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ এর ২ ধারায় মামলাটি করা হয়। পরদিন ৮ জানুয়ারি দিহানকে আদালতে তোলা হলে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
ওইদিন বিকেলে আনুশকার মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেসনিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেছিলেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আনুশকার মৃত্যু হয়েছে। তার যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথ দুই দিক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ময়নাতদন্তে দেহের দুই অংশেই আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে ধস্তাধস্তির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
চেতনানাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, চেতনানাশক কোনো কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কি না তা জানার জন্য নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। ঘটনাস্থলে একাধিক ব্যক্তি ছিল। তাদের ডিএনএ নমুনা এবং ভিসেরাও সংগ্রহ করা হয়েছে।
এমএসি/এনএফ
