শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সুবিধাবঞ্চিত চা বাগানের শিশুরা

শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকেই বঞ্চিত চা শ্রমিকদের সন্তানরা। চা শিল্পে জড়িত জনগোষ্ঠীর শিশুদের যেন চা বাগানের বাইরের পৃথিবী অজানা-অচেনা। এখনো তারা মৌলিক মানবাধিকার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কিছু সামাজিক সংগঠন, বেসরকারি সংস্থা ও এনজিও এগিয়ে আসলেও তা অপর্যাপ্ত।
মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে এডুকো বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইসিডি নেটওয়ার্ক কর্তৃক আয়োজিত চা বাগান ও হাওর অঞ্চলের শিশুদের বিকাশ : সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।
বক্তারা বলেন, চা শিল্পে জড়িত জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। স্বাস্থ্যসম্মত আশ্রয়, নিরাপদ পানি, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা, পুষ্টি-সম্পন্ন খাদ্য, শিক্ষা, পর্যাপ্ত মজুরি, সর্বোপরি আত্ম উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা থেকে তারা বঞ্চিত। যেহেতু তাদের কর্মস্থলে বাস করা বাধ্যতামূলক তাই মালিক পক্ষ বা কোম্পানি কর্তৃক ১০-১২ ফুটের ঘরে তিন পুরুষ ধরে বাস করে আসছে। এমনকি তাদের নিজস্ব কোনো আবাদি জমিও নেই। তারা সবসময়ই দরিদ্র জীবনযাপন করে, সঙ্গে থাকে নিত্য দিনের দুর্ভিক্ষ। অপর্যাপ্ত দৈনিক মজুরির কারণে একজনের মজুরি দিয়ে সংসার চলে না তাই স্বামী ও সন্তানসহ কাজ করেন বাগানে।
অভিযোগ করে বক্তারা বলেন, চা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসতে দেওয়া হয় না, তাদের শিক্ষারও সুযোগ দেওয়া হয় না। অন্যদিকে অভিভাবকরা অধিকাংশ নিরক্ষর বলে সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। এছাড়া সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় বহনের ক্ষমতা ও সামর্থ্য অভিভাবকদের না থাকায় শিশুদের স্কুলের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। শিশুরা বাড়িতে সাহায্য না পাওয়ায় অনেকে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। ফলে চা শিল্পে জড়িত জনগোষ্ঠীর শিশুরা শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়।
অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এডুকো বাংলাদেশের ‘আলোয় আলো ; প্রকল্পের ম্যানেজার মোহাম্মদ শরিফুল আলম। এতে বলা হয়, চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকের শিশুদের শিক্ষার সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার হার যেখানে ৯৫ শতাংশের উপরে, সেখানে চা বাগান অঞ্চলের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার হার ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ সারাদেশের তুলনায় এসব অঞ্চলে ২০ শতাংশেরও অধিক শিশু প্রাথমিকের পূর্বেই ঝরে পড়ে।

‘সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ এলাকায় ৩২টি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে, যেগুলোর সাতটির অবস্থাই নাজুক। এর মধ্যে একটি স্কুল এমন যেখানে, সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য একটি কক্ষ রয়েছে।
শিশু স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে বলা হয়, এসব অঞ্চলের শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত রোগের উচ্চ প্রকোপ রয়েছে। কারণ তারা পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য পায় না। এছাড়াও তাদের মধ্যে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ অনেক বেশি। দেখা গেছে, চা শ্রমিকদের বসবাসরত এলাকায় প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষই বিশুদ্ধ পানি পায় না। বাধ্য হয়েই তারা ঝুঁকিপূর্ণ ঝর্ণার পানি পান করেন। ফলে প্রতিনিয়তই নানা অসুখবিসুখ তাদের লেগে থাকে। এসব শিশুদের সামাজিক সুরক্ষারও অভাব রয়েছে। চা বাগানে কর্মরত পুরুষদের মধ্যে অধিকাংশই মাদকাসক্ত। যে কারণে এসবের প্রভাব পড়ে তাদের সন্তানদের উপর। অনেক সময় নানা কারণে নির্যাতনের শিকার হয় শিশুরা।
সভায় এডুকো বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুল হামিদ সূচনা বক্তব্যে বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশে পিছিয়ে পড়া জনগণের মধ্যে বড় একটা অংশ চা বাগানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী। যারা সব ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। চা বাগানে বসবাসকারী শ্রমিকের সন্তানরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর নিজেরাও বাবা মায়ের সঙ্গে চা শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বিকাশ কিশোর দাস, প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের সদস্য অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ।
টিআই/এসকেডি