কমন-সেন্সের বাইরে…
আমি আমার দীর্ঘ জীবনে যে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখেছি তার মাঝে একটা হচ্ছে পৃথিবীর যেকোনো জটিল বিষয় আসলে কমন-সেন্স দিয়ে মোটামুটি বুঝে ফেলা যায়। একেবারে পুরোটা বোঝার জন্য হয়তো বড় বড় বিশেষজ্ঞ দরকার হয় কিন্তু কাজ চালানোর মতো বোঝার জন্য কমন-সেন্সই যথেষ্ট—বিষয়টা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই হোক আর আমাদের ইভিএম মেশিনই হোক।
তাই হঠাৎ করে যখন কোনো একটা বিষয় আমরা কমন-সেন্স দিয়ে বুঝতে পারি না তখন খুব অসহায় বোধ করি। আমার হঠাৎ করে এরকম একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে, বিষয়টা একটু খোলাসা করে বলি।
আমার ধারণা, মাধ্যমিক পর্যায়ের ৮০-৯০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীই এমপিওভুক্ত এবং রেজিস্টার্ড বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করে। আমাদের সেই স্কুলগুলোতে শিক্ষকের বিশাল ঘাটতি আছে, সংখ্যাটি কত হতে পারে তার সঠিক হিসাব আছে কি না জানা নেই, কিন্তু পত্রপত্রিকায় আশি থেকে পঁচাশি হাজার এরকম একটি সংখ্যা দেখেছি। খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, একবারে চুয়ান্ন হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে।
শিক্ষক নেওয়ার প্রক্রিয়া যথেষ্ট মান সম্মত, স্নাতক-মাস্টার্স করা তরুণ-তরুণীরা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে ‘নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করেছে, এবং শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হবে। কাজেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কাজ এখন খুবই স্বচ্ছ এবং সহজ হওয়ার কথা।
যাদের সনদ আছে তাদের থেকে ক্রমানুসারে চুয়ান্ন হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে শিক্ষক ঘাটতির একটা বড় অংশ পূরণ হয়ে যেতো। তার চাইতে বড় কথা এদেশের অসংখ্য যোগ্য মানুষ এই চাকরির জন্য বসে আছে তাদেরও জীবনে একটা নিশ্চয়তা আসত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেও রেখেছেন মুজিববর্ষে কেউ বেকার থাকবে না।
কিন্তু মোটামুটি হতবাক হয়ে সবাই আবিষ্কার করল চুয়ান্ন হাজার শিক্ষকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন শিক্ষক নেওয়া হলো মাত্র ১৪ হাজার যদিও নিয়োগ দেওয়ার মতো প্রার্থীর কোনো অভাব নেই, তারা রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে ‘নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করে অনেক বছর থেকে অপেক্ষা করে বসে আছেন।
ব্যাপারটা এখানে শেষ হলে একটা কথা ছিল, তার সাথে যেটা হয়েছে সেটা রীতিমতো হৃদয়বিদারক। চুয়ান্ন হাজার পদের ভেতর আরও বাইশ হাজার পদে কাগজে কলমে নিয়োগ দেওয়া হলো, কিন্তু তারা সবাই আগে থেকে চাকরি পেয়ে বসে আছেন, তারা আসলে এক জায়গা থেকে তাদের পছন্দসই অন্য জায়গায় বদলি হয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, বাকি যারা আছেন তাদের নিয়োগ দেওয়া গেল না কারণ ‘উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায়নি’।
যারা এই বিষয়ের প্রক্রিয়া তদারকি করেন (এনটিআরসিএ) তাদের কাছে নিশ্চয়ই এর কোনো এক ধরনের ব্যাখ্যা আছে কিন্তু আমি আমার কমন-সেন্স দিয়ে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
স্কুলের শিক্ষকের প্রয়োজন, শিক্ষক হওয়ার যোগ্য তালিকাভুক্ত প্রার্থী এরই মাঝে পরীক্ষা নিয়ে খুঁজে বের করে রাখা হয়েছে, শিক্ষকের অসংখ্য শূন্য পদ আছে কিন্তু নিয়োগ দেওয়ার বিশাল দক্ষযজ্ঞ করার পরেও পদগুলো খালি রয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষক প্রার্থীরা এই ধরনের বেশ কিছু নির্মম রসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে শাহবাগের কাঠফাটা রোদে বসে গণঅনশন করছেন, কিন্তু কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এই দেশে সবচেয়ে নির্যাতিত প্রজাতি হচ্ছে শিক্ষকেরা। তাদের থেকে হতভাগা যদি কেউ থাকে তারা হচ্ছে শিক্ষক হওয়ার যোগ্য সনদ পাওয়া এই প্রার্থীরা।
বিষয়টা যথেষ্ট নির্মম, আমি সেটা জানতে পেরেছি এই প্রার্থীদের সাথে কথা বলে। (আমি তাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, নিজেদের দুঃখ এবং বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে অনেকেই চোখের পানি ফেলেছেন।)
কোনো একটি অত্যন্ত বিচিত্র কারণে চাকরির জন্য প্রার্থীদের আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হয়। যদিও সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তারা একবার আবেদন করবেন, সেই আবেদনের ভিত্তিতে একটা তালিকা করে রাখা হবে এবং যখন যেখানে ফাঁকা হবে তখন সেখানে এই তালিকা থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
কম্পিউটারের এই যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশ, যেখানে সব মানুষের বায়োমেট্রিক এনআইডি আছে সেখানে পানির মতো সহজ এই কাজটি করা হয় না। সব প্রার্থীকে সব স্কুলে আবেদন করতে হয়, কাজেই অনেক শিক্ষক পদে প্রার্থীরা চাকরি পাওয়ার জন্য নিজেদের জমি বিক্রয় করে একটি নয়, দুটি নয় এক হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন!
প্রত্যেক আবেদনের জন্য যদি ১৫০ টাকা খরচ হয়, তাহলে প্রার্থীর কত টাকা খরচ হয় কেউ সেটা হিসাব করে দেখেছে? একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কমন-সেন্সের অভাবের কারণে চাকরি প্রার্থীদের নিয়ে এই নির্মম রসিকতা করা হচ্ছে নাকি ইচ্ছা করে চিন্তা ভাবনা করে তাদেরকে এভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে সেটি কে আমাকে বুঝিয়ে দেবে?
স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা হচ্ছে। একেকবার একেকটি পরীক্ষায় প্রার্থীরা একেক নম্বর পায়। পদ্ধতির পরিবর্তন হলে মূল্যায়নের সবকিছুই ওলট পালট হয়ে যায়। তাই যদি সবাইকে নিয়ে মেধা তালিকা করা হয় তাহলে কোনো কোনো ব্যাচ লাভবান হবে এবং কোনো কোনো ব্যাচের একেবারে বিনা কারণে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেগুলো সমন্বয় করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও আছে, সেগুলো প্রয়োগ না করে চাকরি প্রার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হলে সেটি হবে চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা।
আমি আরও একটি বিষয় এখনো পুরোপুরি জানতে পারিনি, সেটা হচ্ছে শিক্ষকের চাকরির জন্য সবগুলো নিবন্ধন পরীক্ষা মিলিয়ে সনদ পাওয়া প্রার্থীর প্রকৃত সংখ্যা কত?
যেহেতু একজন এক হাজার স্কুলে আবেদন করে ফেলেন, আবার অনেকেই একাধিক সনদ অর্জন করতে পারেন, অনেকেই অন্য কোথাও চাকরি পেয়ে চলে গেছেন, অনেকে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন তাই আবেদনের সংখ্যা থেকে প্রকৃত সংখ্যা বের করা কঠিন।
(ডিজিটাল বাংলাদেশে সেটা বের করা পানির মতো সোজা হওয়ার কথা, কিন্তু কেন এটা গোপন রাখা হচ্ছে সেটা একটা রহস্য) যারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন তাদের ধারণা প্রার্থীর সংখ্যা বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকের যে কয়টি পদ ফাঁকা আছে সেই সংখ্যা থেকে খুব বেশি হবে না।
যার অর্থ, ঠিকভাবে এই প্রক্রিয়া শেষ করা হলে এটি একটি জাতীয় হতাশা এবং ক্ষোভের ব্যাপার না হয়ে স্কুলে স্কুলে নতুন শিক্ষক পাওয়ার এবং অসংখ্য তরুণ তরুণীর চাকরি পাওয়ার মতো আনন্দময় একটা ব্যাপার হতে পারত! সরকারের বিড়ম্বনাময় ব্যর্থ ইতিহাস না হয়ে এটি সরকারের সাফল্য গাথা হতে পারত।
তবে সেটি নাও হতে পারে, তার কারণ আমাকে বলা হয়েছে এনটিআরসিএ নিজেই জানিয়েছে, দেশে নাকি ষাট হাজার ‘জাল নিবন্ধন সনদধারী’ আছে এবং এর মাঝে এক হাজার থেকে বেশি জাল সনদধারী চাকরি পাওয়া শিক্ষককে তাদের বেতনের টাকা ফেরত দিতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশে—যেখানে সবার বায়োমেট্রিক এনআইডি আছে সেখানে জাল সনদ বের করা রীতিমতো অসম্ভব একটা কাজ। তারপরেও দুর্বৃত্তদের যে বিশাল প্রতিভাবান দল সবাইকে নিয়ে অসম্ভব একটি চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে এই অসাধ্য সাধন করেছেন তাদেরকে ‘অভিনন্দন’!
তবে যে শিক্ষকেরা জাল সনদ নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছেন তারা ক্লাসে চুরি-ডাকাতি-প্রতারণা করানোর বাইরে আর কী পড়ান আমার জানার খুব কৌতূহল।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল ।। কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ