ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার অভিষেক ঘটলো। এর আগে তিনি ২০১৭-২০২১ সাল মেয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের সরকার প্রধানগণ। দীর্ঘদিনের প্রচলিত মার্কিন প্রথা ভেঙে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
ইতিপূর্বে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই রীতি অনুসরণ করেননি। ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু নিজেই ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেননি, সেই সাথে তার দল রিপাবলিকান পার্টি মার্কিন পার্লামেন্টের দুই কক্ষ কংগ্রেস ও সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এ থেকে ধারণা করা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নে বড় কোনো বাধার সম্মুখীন হবেন না।
বিশ্বের প্রায় সবগুলো রাষ্ট্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে তার গৃহীত নীতি দেশে দেশে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার তিন মাস পূর্বে ৫ আগস্ট বাংলাদেশে সংঘটিত হয় অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লব। পতন ঘটে হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের।
পতিত শাসকগোষ্ঠীর অনুগতদের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হয়, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরবে। অতঃপর ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের মধ্যে বিশেষ উচ্ছ্বাস দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের সর্বাধিনায়ক শেখ হাসিনা তার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে ঢাকার রাজপথে মিছিল করার আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দলের নব নিযুক্ত ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ডাইরেক্টর তুলসী গ্যাবার্ডকে ঘিরে বাংলাদেশের বিপ্লবী জনগণকে ভয় দেখানোর প্রচারণা শুরু হয়। কিন্তু দিন যতই গড়ায় আওয়ামী প্রচার-প্রোপাগান্ডা ততই অসাড় প্রমাণিত হতে থাকে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কেমন হবে তা অনুমান করার জন্য দুটো দিক বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রথম দিক হলো যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক। অর্থাৎ বিগত ২০ বছরের মতো বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের স্বার্থ ও ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবে কিনা তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। এছাড়া এ সময় চীন বিরোধী জোট গঠনেও যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কাছে টেনেছিল। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত যে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা থেকে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র বিগত ২০ বছরের যুদ্ধ-বিগ্রহে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এ বিপুল অঙ্কের যুদ্ধ ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ২০০৮ সালে মার্কিন অর্থনীতি মহামন্দার কবলে পড়ে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। ওবামা প্রশাসন ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য প্রত্যাহার করেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রথম মেয়াদে সেই নীতিই অনুসরণ করেন। আর বাইডেন প্রশাসনের শুরুর দিকেই ১৫ আগস্ট ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে বাইডেন প্রশাসন ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরাইল-গাজা যুদ্ধে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যায়।
অবশেষে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা ত্যাগের মাত্র দুই দিন আগে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের ইতি টানে এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সমাপ্তির ভার ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর একপ্রকার ছেড়ে দেয়। এছাড়া বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ বন্ধ করেছে। আর সিরিয়ায় আসাদের পতন পরবর্তীকালে কোনো গোলযোগে হাওয়া না দিয়ে তা সামলানোর দায়িত্বভার তুরস্কের ওপর অর্পণ করেছে।
সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি হলো যুদ্ধে না জড়ানো। এর পরিবর্তে চীনের অর্থনৈতিক উত্থানকে মোকাবিলা করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অগ্রাধিকার। ২০ বছর যুক্তরাষ্ট্র যখন যুদ্ধ-বিগ্রহে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে তখন চীন বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্যের পসরা সাজিয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে প্রাধান্য বিস্তার করে চীনকে টেক্কা দিতে চাইছে।
আরও পড়ুন
এ কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে প্রযুক্তি দুনিয়ার শীর্ষ তারকাদের। টেসলা-স্পেস এক্সের মালিক ইলন মাস্ক, ফেসবুক-মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ, আপেলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক, আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস, গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন প্রমুখ ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাশে অবস্থান করছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতে চাইছেন আমেরিকা প্রথম (ইউএসএ ফার্স্ট) নীতিতে। তিনি মূলত গ্রহণ করতে চাইছেন সংরক্ষণবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। যা অবাধ বাণিজ্য ধারণার বিপরীত। ১৯৪৫ সাল তথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আটলান্টিক পাড়ের দেশগুলো সাথে নিয়ে মুক্ত বাণিজ্য বলয় তৈরি করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংরক্ষণবাদী সমাজতন্ত্রিক অর্থনীতিকে পরাজিত করতে পেরেছিল।
মার্কিন ইচ্ছা ও চেষ্টাতেই চীন ১৯৮০-এর দশকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সদস্য হয়ে সমাজতান্ত্রিক সংরক্ষণবাদী নীতি পরিত্যাগ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছিল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিও। এখন এসব অপেক্ষা করে ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইলেই কি সেই পেছনের ব্যবস্থায় ফেরত যেতে পারবেন?
আমি শুধু উৎপাদন করে রপ্তানি করতে থাকব, অন্য দেশের পণ্য ঢুকতে বাধা তৈরি করব, এমন একচ্ছত্র বাণিজ্য ব্যবস্থার অবসান হয়েছে অনেক আগেই। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ইকোনমিক ন্যাশনালিজম বা অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলেছেন তা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর হতে পারবে তা দেখার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য দ্বৈরথে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতকে বিশেষ কোনো অর্থনৈতিক ছাড় দেবেন না। বরং চীন-রাশিয়ার ব্রিকসকেন্দ্রিক তৎপরতার সাথে ভারতের যুক্ত থাকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কড়া নজর রাখবে। ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের আগেই ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র আর পূর্বের মতো বিশেষ দৃষ্টিতে ভারতকে দেখছে না।
২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের আদালত নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠজন গৌতম আদানির বিরুদ্ধে ঘুষ ও প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। ৩০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, 'অ্যা প্লট ইন প্যারাডাইস অ্যান্ড ইন্ডিয়াস স্ট্রাগল ফর ইনফ্লুয়েন্স ইন এশিয়া (A plot in paradise and India's struggle for influence in Asia)' শিরোনামে এক দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
গ্যারি শিহ এবং সিদ্ধার্থ রায় লিখিত ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুকে উৎখাতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ষড়যন্ত্র করেছিল। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পরদিন ৩১ ডিসেম্বর, 'ইন ইন্ডিয়াস শ্যাডো ওয়ার উইথ পাকিস্তান, অ্যা ক্যাম্পেইন অফ কভার্ট কিলিংস (In India’s shadow war with Pakistan, a campaign of covert killings)' শিরোনামে আরও একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
যাতে বলা হয়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায় ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬ জন পাকিস্তানি ব্যক্তি নিহত হয়। এই দুই প্রতিবেদন ভারতের জন্য এক বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যে অভিবাসন নীতি অবলম্বন করেছেন তাতে অন্যান্য দেশের মতো ভারতেরও হাজার হাজার অভিবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ বিষয়ে ভারত কোনো প্রকার ছাড় পাবে না। তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূল নয় এমন কোনো বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধাও ভারত লাভ করবে না। ভারতকে তার স্বার্থ হাসিল করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যথেষ্ট দরকষাকষি করতে হবে।
সুতরাং ভারত যখন নিজেই তার স্বার্থ নিয়ে দরকষাকষিতে ব্যস্ত, সেই অবস্থায় ভারতের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করার সুযোগ ও সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে পড়বে। কিন্তু তারপরও ভারত বাংলাদেশের ওপর পুনরায় প্রভাব বিস্তারের জন্য মার্কিন আনুকূল্য ও সমর্থন পাওয়ার ক্ষীণ চেষ্টা করে যেতে থাকবে।
তবে তা বিফল হবে। কেননা পরিবর্তিত মার্কিন নীতি হলো যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় জনপ্রিয় শাসকদের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। ভারতীয় আকাঙ্ক্ষায় এ অঞ্চলে কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসককে যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। ফলে চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লব থেকে বাংলাদেশের জনমনে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তাতে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাবে। অর্থাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন হাসিনা পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করবেন না।
বরং বাংলাদেশের জন আকাঙ্ক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ভারতীয় ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক। যার লক্ষণ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত মোদি-বাইডেন বৈঠকে স্পষ্ট হয়েছিল। হাসিনা উৎখাতের মাত্র একমাস পরে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পট পরিবর্তন সম্পর্কে টু শব্দও উচ্চারিত হয়নি। এ থেকেও অনুমান করা যায়, ভারতের কথা শুনে আমেরিকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিন শেষ।
জুবায়ের হাসান ।। রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]