বাংলাদেশে ‘ভুল নজরুল’!

শিল্প-সাহিত্যে জনপ্রিয়তার হিসাব আলাদা; তবে আমার ধারণা, গ্রহণযোগ্যতার বিচারে বাংলাদেশে অন্য লেখকদের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন কাজী নজরুল ইসলাম। এর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে সাহিত্যের পাঠক নয় যারা তাদের। অর্থাৎ বাংলাদেশে যারা সাধারণত গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়েন না, তাদের কাছেও লেখক হিসেবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নাম হলো কাজী নজরুল ইসলাম।
বিষয়টি ভাবতে কিন্তু ভালোই লাগে। কিন্তু ব্যথিত হই যখন বুঝতে পারি, এর পেছনের কারণটা হলো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা। আর এই কারণে বাংলাদেশে সঠিক নজরুলের পাঠ ও চর্চা হয়েছে কিনা সন্দেহ জাগে। খণ্ডিত নজরুলকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নজরুলের যে বিশালত্ব ও বহুত্ববাদ, তা থেকে যেমন নিজেকে বঞ্চিত করেছে বাঙালি মুসলমান সমাজ, তেমনি সাম্প্রদায়িক জায়গা থেকে নজরুলচর্চা করতে গিয়ে তাকে অনেকাংশে খর্বিতও করেছে।
প্রথম ভুলটা করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে নজরুলকে প্রতিষ্ঠা করাতে গিয়ে। নব্বইয়ের দশকে আমরা মফস্বলের মানুষেরা শুনে শুনে বড় হয়েছি, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কাজী নজরুল ইসলামকে ধুতুরা ফল খাইয়ে পাগল করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটা করতে তিনি তার মেয়ের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে দেন। নজরুলকে পাগল করে দিয়েই মূলত তিনি নোবেল পুরস্কারটা বাগিয়ে নিয়েছেন। না হলে এটা নজরুলেরই পাওয়ার কথা ছিল। লজ্জা লাগে ভাবতে, সেই অপপ্রচার এমনই চতুর্মুখী ছিল যে, আমি কিছুদিনের জন্য সেটা বিশ্বাসও করেছিলাম।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে, আর রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পান ১৯১৩ সালে। এই দুই কবি পরস্পরের নৈকট্যেই ছিলেন। অনুজ হিসেবে নজরুল ছিলেন গভীরভাবে রবীন্দ্রভক্ত।
অথচ তখন যে কথা আমাদের কেউ বলেনি, কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে, আর রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পান ১৯১৩ সালে। এই দুই কবি পরস্পরের নৈকট্যেই ছিলেন। অনুজ হিসেবে নজরুল ছিলেন গভীরভাবে রবীন্দ্রভক্ত। নজরুলের রচনাতে বহু জায়গাতে রবীন্দ্রনাথের গান, উদ্ধৃতি, বাক্য, বাক্যাংশ পাওয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুলের কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ কবিতাও আছে। রবীন্দ্রনাথের আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে লেখা ‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি’ নামক কবিতায় নজরুল লিখেছিলেন, ‘একা তুমি জানিতে হে কবি, মহাঋষি, তোমারি বিচ্যুত-ছটা আমি ধূমকেতু।’
অন্যদিকে নজরুলের বয়স যখন মাত্র বিশ, তখনই তাকে কবি সম্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ নাটকটি উৎসর্গ করেন। রবীন্দ্রনাথ এই প্রথম অত্যন্ত আপনজনদের বাইরে অপরিচিত কোনো কবিকে বই উৎসর্গ করেন। এটি কম কথা নয়।
আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়, রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ৬০, নজরুলের ২২। কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরিতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত সভায় সভাকক্ষে প্রবেশ করেই নজরুল মঞ্চে উঠে রবীন্দ্রনাথের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখন নজরুলের হাত ধরে সভায় নিজের পাশে বসান।
নজরুল সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম পাতায় মুদ্রিত হয় রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী। তিনি লেখেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,/আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা,/জাগিয়ে দেরে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধচেতন।”
নজরুল-রবীন্দ্রনাথের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। কিন্তু এই গদ্যের বিষয় সেটি না। বিষয়টি এই কারণে উল্লেখ করা যে, নজরুল নিজে যখন রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথ যখন নজরুলকে পরম স্নেহ করেছেন, সেখানে আমাদের সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা চরিতার্থ করতে দুজনকে প্রতিপক্ষ করে তুলেছি।
সচেতনভাবে নজরুল যে পরিচয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি, সেই পরিচয়টাই তার ওপর আরোপ করেছি বা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অথচ লেখালেখির শুরু থেকেই নজরুল সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সর্বমানবিক চেতনার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে চেয়েছেন। লেখক হিসেবে তার অবস্থানটা ছিল পরিষ্কার। তিনি শুধু নিজের রোম্যান্টিক ভাব প্রকাশের জন্য কলম ধরেননি। সাহিত্য তার কাছে নিছক বিনোদনের অংশ ছিল না।
নজরুল তার ‘বর্তমান বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধে সাহিত্যকে দুটি ধারায় ভাগ করেছেন। তার মতে, একটি ধারা শেলির Shylark-এর মতো, মিল্টনের Bird of Paradise-এর মতো এই ধূলিমলিন পৃথিবীর ঊর্ধ্বে উঠে স্বর্গের সন্ধান করে। স্বপ্নলোকের সংগীত শোনায়। অন্যধারা মাটির পৃথিবীকে আঁকড়ে ধরে থাকে। দুঃখময় পৃথিবীকে বাদ দিয়ে সে স্বর্গ চায় না। দ্বিতীয় ধারার লেখকরা স্বর্গকে মাটিতে নামিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
নজরুল বলছেন, ‘দুই দিকেই বড় বড় রথী মহারথী। একদিকে নোগুচি, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি স্বপ্নচারী; আর একদিকে গোর্কি, যোহান, বোয়ার, বার্নার্ড শ, বেনাভাঁতে প্রভৃতি।’
দৃশ্যত দ্বিতীয় ধারার লেখকদের প্রতি নজরুলের পক্ষপাত স্পষ্ট। নজরুলের মতো মানবতার পূজারি, সাম্যবাদের প্রচারক লেখক শুধু ভারতবর্ষে না, বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। অথচ তাকেই কিনা আমরা একক সম্প্রদায়ের কবি করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। এই চেষ্টা একবার করেছিলেন ইব্রাহীম খাঁ, উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজ-সংস্কারক। তিনি নজরুলকে মুসলমান সমাজের কবি হয়ে ওঠার জন্য এবং ইসলামি ধারার কবিতা রচনার আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র লেখেন।
পত্রে নজরুলকে ইব্রাহীম খাঁ লেখেন, “বাংলায় মৌলানা রুমীর আসন খালি পড়ে রয়েছে, তুমি তাই দখল করে ধন্য হও, বাংলার মুসলিমকে, বাংলার সাহিত্যকে ধন্য করো। তাই আজ বড়ো আশায়, বড়ো ভরসায়, বড়ো সাহসে, বড়ো মিনতির স্বরে তোমায় বলছি, ভাই, কাঙাল মুসলিমের বড়ো আদরের ধন তুমি, তুমি এই দিকে, পতিত মুসলিম সমাজের দিকে, এই অবহেলিত ইসলামের দিকে একবার চাও; তাদের ব্যথিত চিত্তের করুণ রাগিণী তোমার কণ্ঠে ভাষা লাভ করে আকাশ-বাতাস কাঁদিয়ে তুলুক, তাদের সুপ্ত প্রাণের জড়তা তোমার আকুল আহ্বানের উন্মাদনায় চেতনাময়ী হউক, ইসলামের মহান উদার উচ্চ আদর্শ তোমার কবিতায় মূর্তি লাভ করুক, তোমার কাব্য-সাধনা ইসলামের মহাগীতিতে চরম সার্থকতায় ধন্য হোক। আমীন।”
আরও পড়ুন
এই পত্রের উত্তরে নজরুল লেখেন, “...আমায় মুসলমান সমাজ 'কাফের' খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনো দিন অভিযোগ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের আখ্যায় বিভূষিত হবার মতো বড়ো তো আমি হইনি। অথচ হাফেজ-খৈয়াম-মনসুর প্রভৃতি মহাপুরুষদের সাথে কাফেরের পঙ্ক্তিতে উঠে গেলাম।... হিন্দুরা লেখক-অলেখক জনসাধারণ মিলে যে স্নেহে যে নিবিড় প্রীতি-ভালোবাসা দিয়ে আমায় এত বড়ো করে তুলেছেন, তাঁদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি, তা হলে আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশ্য, কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমায় কিছু দিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া 'হিন্দুসভাওয়ালা' আমার নামে মিথ্যা কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এঁদের আঙুল দিয়ে গোনা যায়। এঁদের অবিচারের জন্যে সমস্ত হিন্দুসমাজকে দোষ দিই নাই এবং দেবও না।”
নজরুলের বয়স যখন মাত্র বিশ, তখনই তাকে কবি সম্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ নাটকটি উৎসর্গ করেন। রবীন্দ্রনাথ এই প্রথম অত্যন্ত আপনজনদের বাইরে অপরিচিত কোনো কবিকে বই উৎসর্গ করেন।
এই চিঠির শেষটা আমাদের নজরুলকে আরও পরিষ্কারভাবে চিনিয়ে দেয়। তিনি শেষটা করেছেন এই বলে, “আপনার 'মুসলিম-সাহিত্য' কথাটার মানে নিয়ে অনেক মুসলমান সাহিত্যিকই কথা তুলবেন হয়তো। ওর মানে কি মুসলমানের সৃষ্ট সাহিত্য, না মুসলিমভাবাপন্ন সাহিত্য? সাহিত্য যদি সত্যিকার সাহিত্য হয়, তবে তা সকল জাতিরই হবে। তবে তার বাইরের একটা ফর্ম থাকবে নিশ্চয়। ইসলাম ধর্মের সত্য নিয়ে কাব্য-রচনা চলতে পারে, কিন্তু তার শাস্ত্র নিয়ে চলবে না—ইসলাম কেন, কোনো ধর্মেরই শাস্ত্র নিয়ে কাব্য লেখা চলে বলে বিশ্বাস করি না।...বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানের উভয়েরই সাহিত্য।…আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী।”
নজরুলের এই স্পষ্ট অবস্থানের কারণে সমকালে কেউ তাকে যবন, কেউ কাফের বলে গালি দিয়েছেন। নজরুল তাদের জবাব দিয়েছেন এই বলে, ‘আমি দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু-মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’
এখানে আরও স্মর্তব্য, নজরুল শুধু তার রচনা, বচনে না; কর্মে-মর্মে, এমনকি যাপনেও যে এই মহৎ চেষ্টাটা করে গেছেন, তার নমুনা তার পারিবারিক জীবন থেকে পাওয়া যায়, প্রথম স্ত্রী সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিসের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তিনি বিয়ে করেন হিন্দুধর্মাবলম্বী আশালতা সেনগুপ্তাকে। নজরুল তার নাম দেন প্রমীলা দেবী।
চার সন্তানের নাম রাখেন পর্যায়ক্রমে—কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (ডাকনাম বুলবুল), কাজী সব্যসাচী (যাকে কবি চীনের বিপ্লবী নেতা সান-ইয়াৎ সেনের নাম থেকে সানি নামে ডাকতেন) ও কাজী অনিরুদ্ধ (যাকে লেনিনের নাম অনুসরণে কবি ‘নিনি’ নামে ডাকতেন)। তার এক পুত্রবধূ উমা (মুখোপাধ্যায়) কাজী, অন্যজন কল্যাণী কাজী।
নির্বাক ও প্রায় স্মৃতিশক্তিহীন নজরুল ইসলামকে আমৃত্যু সেবিকার যত্নে, কন্যার ভালোবাসায় এবং মায়ের স্নেহে আগলে রেখেছিলেন যিনি, তিনিই উমা কাজী, ব্রাহ্মণ পরিবারের এই নারী। কাজেই নজরুলকে যদি গ্রহণ করতেই হয়, তাহলে সামগ্রিক নজরুলকে গ্রহণ করতে হবে। নজরুলকে চর্চা করতে হলে তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার চর্চা করতে হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ চর্চা আর নজরুলচর্চা এক হৃদয়ের কাজ না।
লক্ষ্য করে দেখুন, যে কবিকে বাঙালি মুসলমানের একটা বড় অংশ নিজেদের একক সম্পত্তি করে তুলতে চান, সেই কবি যদি আজকের এই সময়ে লিখলেন—‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা/ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ/ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত/এক মানবের একই রক্ত মেশা/কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।”
কিংবা নিজের সন্তানের নাম রাখতেন—‘কৃষ্ণ মুহাম্মদ’, তাহলে ওরাই হয়তো আজ নজরুলকে ধর্মানুভূতিকে আঘাত হানার অভিযোগে ফাঁসিয়ে দিতেন কোনো মামলায়!
যে-হৃদয় বিষাক্ত, সে-হৃদয় ফুলের মধুকেও বিষ হিসেবে গ্রহণ করে। তা দিয়ে মধুর গুণবিচার করা যায় না। কাজী নজরুল ইসলামকে মূল্যায়ন করতে হলে তাকে সামগ্রিক অবস্থান থেকে গ্রহণ করতে হবে। নজরুলের গজলও সত্য, শ্যামা সংগীতও সত্য। সত্য ধর্মীয় ভণ্ডামি ও কূপমণ্ডুকতা বিরোধী উচ্চারণ। আর এই কারণেই ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিরোধ হিসেবে নজরুল-চর্চা অনস্বীকার্য। তিনি আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদকে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই যথার্থরূপে চিনে নিতে হবে।
মোজাফ্ফর হোসেন ।। কথাসাহিত্যিক
