কেন নজরুল আজও প্রাসঙ্গিক?

আমার চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের জাতীয় কবি। দুঃখ ছিল যে কবির চিরসাথী। সেই কবির মৃত্যুবার্ষিকী আজ। দুখু মিয়ার জীবন সংগ্রাম আর সাহিত্য কর্ম আমাদের জন্য আজও প্রেরণার বাতিঘর। জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও কবি নজরুল ছিলেন অনুপ্রেরণার কেন্দ্রে।
পৃথিবীর প্রতিটি অধিকারহারা জনগোষ্ঠী কবি নজরুলের বিপ্লবী সৃষ্টিকর্ম অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে অনন্তকাল।
বহুমুখী প্রতিভার আধার কাজী নজরুলের প্রায় ৩ সহস্রাধিক গান, নজরুল গীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, প্রসিদ্ধ। যুগে যুগে যতবার দেশে ফ্যাসিবাদের আগমন ঘটবে নজরুল বিদ্রোহী হয়ে ততবার ফিরে আসবে আমাদের মাঝে।
মাত্র ২২ বছর বয়সে কবি নজরুল লিখেছেন, ‘বল বীর - চির উন্নত মম শির।’
আরও লিখেছেন, ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট ভেঙ্গে ফেল্ কর্ রে লোপাট রক্ত-জমাট শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!’—জালিম শাসকের বিরুদ্ধে আজও এই গান অনুপ্রেরণার উৎস।
‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’—লিখে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অমোঘ বাণী উচ্চারণ করেন তিনি। গাহি সাম্যের গান একমাত্র নজরুলের লেখনীতে সঠিকভাবে ফুটে ওঠে।
শিশুদের ছড়া সাহিত্যকে তিনি অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ইসলামী গজল, হিন্দুদের কীর্তন রচনায়ও তিনি অনবদ্য সৃষ্টিশীলতার পরিচয় রেখেছেন। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’—গানটি না শুনলে কোন বাঙালি মুসলমানের হৃদয়ে রোজার ঈদের আনন্দ অনুভূত হয় না।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাকশক্তিহীন অসুস্থ কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। করা হয় জাতীয় কবি। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান সূচক ডি-লিট উপাধি দেওয়া হয় কবি নজরুলকে।
১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। একই বছর দেওয়া হয় একুশে পদক। সরকারিভাবে ধানমন্ডিতে একটি বাড়িও দেওয়া হয় কবিকে। অসুস্থ কবি ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
‘মসজিদেরি পাশে আমার কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুন্তে পাই।।’
কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়েছে।
শত প্রতিকূলতা নজরুলের প্রতিভাকে আটকাতে পারেনি। তাই তো এই কবিকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র হিসেবে ধরা হয়। তার বিচরণ ছিল সাহিত্যের প্রতিটি শাখায়। কবিতা, গান, নাটক থেকে শুরু করে সাহিত্যের সব জায়গায় সমান পারদর্শী ছিলেন তিনি। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্য কর্ম অমর করে রেখেছে কবিকে, আছে আট হাজারেরও বেশি সাহিত্যকর্ম। যার বেশিরভাগই সংরক্ষণ করা যায়নি।
কবিতা আর গানের পাশাপাশি সাংবাদিকতায়ও বিপ্লবী ধারার সূচনা করেন তিনি। অগ্নিবীণা, ধূমকেতু এগুলো একেকটি বিদ্রোহের নাম। বিংশ শতাব্দীতে তার মতো একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিকের মতো গুণাবলী খুব কম মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়। সব সময় অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে সাহস করে লিখতে পারাটাই অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছে নজরুলকে।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ একজন মানুষ। বলা যায় আর দশ জন সাধারণ মানুষের চেয়েও সাধারণ।
বেশ রসিক মানুষ ছিলেন। তার কথা শুনে যে কেউ হেসে গড়াগড়ি খেতেন। হিরণ্ময় ভট্টাচার্য ‘রসিক নজরুল’ নামে একটি বই লিখেছেন। যারা বইটি পড়েননি, তাদের পক্ষে বোঝা কষ্টকর নজরুল কী পরিমাণ রসিক ছিলেন!
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, একবার এক ভদ্রমহিলা নজরুলকে খুব স্মার্টলি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি পানাসক্ত?’ নজরুল বললেন, ‘না, বেশ্যাসক্ত!’ কবির কথায় ভদ্রমহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। আর তক্ষুণি ব্যাখ্যা করলেন নজরুল, ‘পান একটু বেশি খাই। তাই বেশ্যাসক্ত, অর্থাৎ বেশি+আসক্ত = বেশ্যাসক্ত!’
কবির কথা, ব্যবহারে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য হতেন যে কেউ। পুরুষ কিংবা নারী যেই হোন না কেন, এমনকি চরম শত্রুরাও তার ভালোবাসার শক্তির কাছে হার মানতেন।
কবি বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে প্রথম দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। তিনি লিখেছেন, ‘সেই প্রথম আমি দেখলাম নজরুলকে। এবং অন্য অনেকের মতো যথারীতি তার প্রেমে পড়ে গেলাম!’
শুধু বুদ্ধদেব বসু নন, তার স্ত্রী প্রতিভা বসুও নজরুলের প্রেমে পড়েছিলেন। সেই কাহিনি নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘আয়না’ নামের একটি গল্পে।
লেখার জন্য কোনো বিশেষ পরিবেশ লাগতো না কবির। গাছতলায় বসে যেমন তিনি লিখতে পারতেন, তেমনি ঘরোয়া বৈঠকেও তার ভেতর থেকে লেখা বের হতো। লিখতে বসলে কবি সঙ্গে রাখতেন চা আর জর্দা দেওয়া পান। চা আর পানের ভীষণ নেশা কবির।
লেখার সময় চা আর থালা ভর্তি পান নিয়ে বসতেন তিনি। পান শেষ করে চা, এরপর আবার চা শেষ করে পান খেতেন। তীব্র চায়ের নেশার কারণে সময়মতো চা না পেলে তার মন অস্থির হয়ে উঠত এবং লেখালেখিও থেমে যেত।
অনেকেই এর সুযোগ নিতেন। কাজ আদায় করার জন্য কবিকে খাতা-কলম, পান-জর্দা দিয়ে একটি বন্ধ ঘরে বসিয়ে দিতাম। যেখানে তিনি চা-পান করতেন আর লিখতেন। এভাবে কত রচনা, কত কালজয়ী গান সৃষ্টি হয়ে গেছে তার সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই।
চা ছাড়া কবি কিছুই লিখতে পারতেন না। গানও গাইতে পারতেন না। একবার তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংসদ নির্বাচনে দাঁড়ালেন। যেহেতু পূর্ববঙ্গে তার পরিচিতি বেশি। তাই তিনি চাইলেন পূর্ববঙ্গে জনসভা করবেন।
এজন্য কয়েকটি জনসভা করতে ফরিদপুর এলেন নজরুল। বেশ কিছুদিন ফরিদপুর থাকতে হবে কবিকে। কবির বন্ধু পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি ফরিদপুরের তাম্বূলখানা গ্রামে। সেখানেই নজরুলের থাকার ব্যবস্থা হলো।
কবি নজরুলের আগমনে গানের আসর বসল। গভীর রাত পর্যন্ত চলবে গানের আসর। কবি গান গাইবেন। প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে। কিন্তু বিদ্রোহী কবির চায়ের তেষ্টা পেল মাঝরাতে। গান বন্ধ করে দিলেন তিনি। চা ছাড়া আর একটি গানও নয়, জানিয়ে দিলেন সাফ। জসীমউদ্দীন পড়লেন বিপাকে। এখন চা পাবেন কোথায়!
রাত ১২টা পার হয়েছে। ঘুমিয়ে গেছে পুরো গ্রাম। কিন্তু কবির তো চা চাই-ই চাই। গাঁয়ের লোকে চা খেতে শেখেনি তখনো। তবু জসীমউদ্দীন সারা গ্রামের লোককে জাগিয়ে তুললেন, ঘুম ভাঙানোর অপরাধে কেউ রেগে গিয়েছিল কি না কে জানে। কারও বাড়িতে চা পাওয়া গেল না।
যখন সবাই হতাশ, এক ভদ্রলোকের কাছে পাওয়া গেল অল্প কিছু চায়ের লিকার। ভদ্রলোক নিজে চা খান না, অতিথি আসলে খেতে দেন। আপ্যায়নের জন্য জমিয়ে রেখেছেন কয়েক বছরের পুরোনো চা। সেগুলো দিয়েই তেষ্টা মেটালেন নজরুল। তারপর রাতভর গান হলো। কিন্তু যে নির্বাচনের জন্য ফরিদপুর এসেছিলেন সেই নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল বিদ্রোহী কবির।
আরও একবার জসীমউদ্দীনের বাড়ি গিয়েছিলেন কবি। নজরুল চা পান করবেন বলে পল্লীকবি বাজার থেকে চা পাতা এনে বাড়ির বউ-ঝিকে বানানোর জন্য দেন। এদিকে বাড়ির বউ-ঝিরা এর আগে চা বানাননি। তারা বাড়িতে যত রকম মসলা ছিল (আদা, মরিচ, পেঁয়াজ, ধনে, জিরা ইত্যাদি) সবকিছু দিয়ে দারুণ এক কাপ চা খাওয়ালেন নজরুলকে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন পরে তার স্মৃতিকথাতে এসব কথা লিখে গেছেন।
সাম্য, প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু দিবসে বিশ্বের সব বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই। অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।
কাজী নজরুল ইসলামের অমর বাণীকে বুকে ধারণ করে তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন সংগ্রামে লড়ে যাবে সেই প্রত্যাশা রইল।
মাহমুদ সোহেল : সাংবাদিক