দেশের ফুটবলে নারীরাই হোক পথের দিশারি

পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল…, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মরণীয় এই গানের কলির মতোই বাংলাদেশের ফুটবলাকাশের পূর্বদিগন্তে নতুন সূর্যের দেখা মিলেছে! যে সূর্য আভায়-বিচ্ছুরণে প্রতিভাত হচ্ছে দিগ্বিদিক। দশকের পর দশক ধরে যে হতাশা-দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছে এদেশের পুরুষ ফুটবল দল, সেই হতাশা ভুলিয়ে দিয়েছে নারী ফুটবল দল!
শীর্ষ খেলোয়াড়দের বিদ্রোহ, কারও দল ছেড়ে সংসারী হওয়া—কত কী ঘটেছে, কিছুই আটকে রাখতে পারেনি অদম্য নারীদের! কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাফুফে নারী ফুটবলের যে ভিত তৈরি করে দিয়ে গেছেন—সেটি এখন আরও পত্র-পল্লবে বিকশিত আরও শক্তিশালী!
নারী ফুটবল চালানো বাফুফে’র মতো গরিব ফেডারেশনের জন্য ছিল সহজ এক কাজ। এখানে টাকা পয়সার চটকদারি ছিল না, ছিল না ক্লাব ফুটবলের দাপট। আর তাইতো শ্রম-মেধার বিনিয়োগ এখানে সহজ হয়েছে, ফলও মিলেছে। পুরুষ ফুটবলে ক্লাব কাঠামোর দুর্বলতা রয়েছে, সেখানে নেই বয়সভিত্তিক ফুটবল, নেই হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ফুটবল, নেই শহরভিত্তিক দল; যে কারণে তৈরি হচ্ছে না সাপোর্টার গ্রুপ। এই দূরবস্থা কাটানোর জন্য এখন প্রবাসী ফুটবলারদের দিকে ঝুঁকছে ফুটবল ফেডারেশন, কিন্তু তাতে কি মিলবে সাফল্য?
বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল একবারই কেবল এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে—সেটি ১৯৮০ কুয়েত এশিয়ান কাপে! সালাউদ্দিন-চুন্নুরা খেলেছিলেন সেই আসরে। এরপর শুধুই হাপিত্যেশ, আর কখনো ধারে-কাছেও যেতে পারেনি বাংলাদেশ! এরপর বিভিন্ন সময়ে চারবার এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে ভারত, সবশেষ ২০১৯ ও ২০২৩ আসরেও খেলেছে তারা।
দক্ষিণ এশিয়ায় আর কেউ এশিয়ান কাপ খেলেনি, এখন ২৪ দেশের এই আসরে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি প্রায় দুর্লঙ্ঘ! যদিও এবারের বাছাইপর্বে ভারতকে রুখে দিয়ে শুরু করলেও হারতে হয়েছে সিঙ্গাপুরের কাছে! হামজা-শামিতদের মতো ইউরোপ-কানাডায় খেলা ফুটবলারদের দলে ভিড়িয়েও ভাগ্য বদল যে অনেক কঠিন, তা ইতিমধ্যে টের পেয়েছে বাফুফে!
আর এখানেই নারী ফুটবল যেন বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার! ২৪ দেশের চূড়ান্ত পর্বে যেখানে পুরুষরা সুযোগ পায় না, সেখানে ১২ দেশের নারী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। এবং এখানে ফুটবলের সবচে দুর্বল অঞ্চল সাফ’-এর রয়েছে দুই প্রতিনিধি- ভারত ও বাংলাদেশ। আছে আসিয়ানের দুই সদস্য ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন!
আসিয়ান ও সাফ অঞ্চল মিলে ১৭টি দেশ রয়েছে, সেখান থেকে চারটি দেশ এবার খেলবে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য চূড়ান্ত পর্বে, যা অনুষ্ঠিত হবে ০১-২১ মার্চ ২০২৬। ০২ জুলাই মিয়ানমারকে হারিয়ে বাংলাদেশ সত্যিই অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড ঘটিয়েছে এবং নারী ফুটবল বলে কোনোভাবেই এদের ছোট করে দেখার উপায় নেই!
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, সম্প্রতি কোচ পিটার বাটলার ইস্যুতে যে বিপ্লব ও বিদ্রোহে উত্তাল হয়েছিল ফুটবলাঙ্গন, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সেই কোচের অধীনে মিলেছে দেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্য! নারী ফুটবলে সাফল্যের মূল রহস্য আসলে লুকিয়ে আছে তৃণমূলে! প্রতিভা বের হচ্ছে নিয়মিত। তবে এই সংকট রয়ে গেছে পুরুষদের ফুটবলে। সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম স্ট্রাইকার সংকট, কোনোভাবেই উঠে আসছে না তরুণ প্রতিভা। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব ফিরে পেতে হলে ব্যক্তিগত স্কিলফুল খেলোয়াড় সৃষ্টির বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি তাবিথ আউয়াল সম্প্রতি নেপালের কাঠমান্ডু পোস্টকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেখানে তিনি পরিষ্কার রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। বয়সভিত্তিক ফুটবল ও ক্লাবের গাঠনিক সংস্কারে মনোযোগ তার। ৮ থেকে ১২, ১২ থেকে ১৪, ১৪ থেকে ১৬, আর ১৭ থেকে ১৯- এই চার ধাপে বয়সভিত্তিক ফুটবলকে এগিয়ে নিতে চান তাবিথ আউয়াল।
নারী ফুটবল যেন বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার! ২৪ দেশের চূড়ান্ত পর্বে যেখানে পুরুষরা সুযোগ পায় না, সেখানে ১২ দেশের নারী এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ।
এতে যদি ভাগ্যের চাকা খোলে পুরুষ ফুটবলে! স্থানীয় নারী ফুটবলাররা ভুটান-মালদ্বীপসহ নানা দেশে খেলতে যাচ্ছে, কিন্তু পুরুষ ফুটবলারদের চাহিদা নেই! আর এজন্যই বাংলাদেশ লিগে সাফ অঞ্চলের ফুটবলারদের ‘লোকাল’ হিসেবে খেলতে দিচ্ছে বাফুফে, যেন একই নীতি অনুসরণ করে ভারত-নেপাল-মালদ্বীপও বাংলাদেশি ফুটবলারদের সুযোগ দেয়!
এক দশকে সাফ-এর প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ৭০ ধাপ এগিয়েছে র্যাঙ্কিংয়ে। কীভাবে সম্ভব হলো এই উন্নতি? ইংলিশ কোচ স্টিফেন কনস্ট্যানটাইনের আমলে ভারত বিপুল উন্নতি করেছে। এই কোচকে দীর্ঘ তিন বছর ধরে রেখে পরিকল্পনা করে এগিয়েছে ভারত। বয়সভিত্তিক ফুটবলে মনোযোগ দিয়েছে, একেবারে দুধের শিশুকে ফুটবল ধরিয়ে দিয়েছে- নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলেছে!
আরও পড়ুন
ভারতীয় দলে দেখা যায় পাহাড়ি ও পার্বত্য অঞ্চলের ফুটবলারদের আধিক্য! বাইচুং ভুটিয়া-সুনীল ছেত্রীরা এসেছেন এই পূর্বের কঠিন পাহাড় থেকে। বাংলাদেশের ফুটবলেও এখন এই পাহাড়ি ফুটবলারদের আধিক্য! নারী ফুটবলার ঋতুপর্ণা এখন পাহাড়ি ফুটবলারদের রোল মডেল। ইতিমধ্যে তারকা খ্যাতি জুটে গেছে এই নারীর ভাগ্যে।
আপাতত বয়সভিত্তিক ফুটবলে সাফ অঞ্চলে কর্তৃত্ব করার আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের। মূলত নারীদের দেখানো পথেই হাঁটছে পুরুষদের ফুটবল! স্কুল ফুটবলে নারীদের অন্তর্ভুক্তির পরপরই বদলে গেছে এদেশের ফুটবল! দারুণ সব নারী ফুটবলার উঠে এসেছে। পুরুষ ফুটবলে প্রতিভা অন্বেষণ ও লালন-পালনের যে আকাল চলছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বাফুফে! এজন্য সবচেয়ে জরুরি ক্লাব সংস্কার!
বয়সভিত্তিক দল থাকবে সেখানে, থাকবে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর মতো একাডেমি, থাকবে স্কাউট। সারাদেশ থেকে যারা খুঁজে বের করবে দারুণ সব প্রতিভা। বলা হয়, যে দেশে ক্লাব ফুটবল যতটা সুসংগঠিত, সে দেশের ফুটবল ততটা সফল আন্তর্জাতিক ফুটবলে।
ভেবে দেখুন তো, ইউরোপের দেশ স্পেনের ক্লাব বার্সেলোনার স্কাউট লিওনেল মেসিকে খুঁজে পেয়েছিলেন সেই দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে! মেসির প্রথম চুক্তি হয়েছিল একটি টিস্যু পেপারে। শুধুমাত্র তৈরি ফুটবলার দলে ভিড়িয়ে ঘরোয়া ফুটবলে সময় অতিবাহিত করা যাবে, কিন্তু দেশের ফুটবলের তাতে কল্যাণ হবে না!
বাংলাদেশের শীর্ষ ক্লাবগুলোর বোধোদয় হওয়া দরকার। তারা কি দেখে না, ভারতে পেশাদার লিগ- ইন্ডিয়ান সুপার লিগ খেলার জন্য কী কী শর্ত পূরণ করতে হয় ক্লাবগুলোর? বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের উচিত এই বিষয়ে কঠোর থাকা।
আশেপাশের দেশগুলোর মধ্যে শুধু ভারত নয়, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে জমজমাট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগ হয়, সেই নিরিখে বাংলাদেশ পেশাদার লিগ যোজন-যোজন পিছিয়ে। জাতীয় দলকে আকর্ষণীয় করতে হলে পেশাদার লিগ ব্যতিরেকে সম্ভব নয়! একসময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, থাইল্যান্ড, হংকং এরা নিয়মিত এশিয়া কাপ খেলছে, আর বাংলাদেশ তা তাকিয়ে দেখছে!
নারী ফুটবলে সাফল্যের মূল রহস্য আসলে লুকিয়ে আছে তৃণমূলে! প্রতিভা বের হচ্ছে নিয়মিত। তবে এই সংকট রয়ে গেছে পুরুষদের ফুটবলে।
নারীদের এগিয়ে চলা কি পুরুষদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে না? তারা যদি র্যাঙ্কিংয়ে ৭০/৮০ ধাপ এগিয়ে থাকা দলকে হারাতে পারে, তবে পুরুষরা নয় কেন? আক্রমণভাগে সাবিনা-সাগরিকা-শামসুন্নাহার-ঋতুরা যদি বলে-কয়ে গোল করতে পারেন, তবে পুরুষরা কেন পারেন না?
বিশ্বাসটা রাখতে হবে যে, এদেশেও ঋতুপর্ণার মতো মিডফিল্ডার, সাবিনার মতো রিয়েল নম্বর নাইন তৈরি হবে পুরুষদের ফুটবলে। নারীরাই হোক পথের দিশারী। আলোটা যেহেতু জ্বলেছে আলোকিত হবে গোটা প্রাঙ্গণে আশা করাই যায়!
ফুটবলে জাপানের কথাই বলা যাক! সেই নব্বইয়ের দশকে পেশাদার লিগ চালু হয়েছে সেখানে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশটির পুরুষ ফুটবল দলের চেয়ে এগিয়ে নারী ফুটবল দল। নারীরা একবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে, একবার খেলেছে অলিম্পিক ফাইনাল, জিতেছে এশিয়ান কাপ। সেখানে পুরুষ দলের বিশ্বকাপে সেরা সাফল্য শেষ ষোলতে খেলা!
একবার কনফেডারেশন কাপের ফাইনাল খেলা কিংবা চার-চারটি এশিয়ান কাপ জয়ের স্মৃতি থাকলেও সাফল্যের মানদণ্ডে এগিয়ে নারীরাই। অথচ জাপানে নারী ফুটবলে মনোযোগ অনেক পরে, এই শতাব্দীর শুরুর দশকে। এক বিশেষ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সারা জাপান থেকে তিন হাজার ক্ষুদে ফুটবলার খুঁজে বের করা হয়। জাপানজুড়ে শুরু হয় নারী ফুটবলের বিপ্লব, তারই ফলশ্রুতিতে পরের দশকেই দেশটি হয়ে যায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন! জাপানের এই উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশ।
দলগত খেলায় ক্রিকেটের পর হকিতে সাফল্য এসেছে এদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। ২০২৫ সালে চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিতব্য যুব বিশ্বকাপ হকিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। নারী এশিয়া কাপ খেলতে যাচ্ছে নারী ফুটবল দল। আমরা অপেক্ষায় থাকছি- কোনো একদিনের অপেক্ষায়, যেদিন পুরুষ ফুটবল দলও এমন সংবাদের অবতারণা করবে, গোটা জাতিকে আনন্দে ভাসাবে!
মানজুর মোরশেদ : এডিটর (স্পোর্টস অ্যান্ড নিউজ), টি-স্পোর্টস