ইসলামের শত্রু আবু জাহেলের ছেলে যেভাবে মুসলমান হয়েছিলেন
ইসলামের প্রথম যুগে মক্কার সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাচারীদের একজন ছিলেন আবু জাহেল। তিনি ছিলেন মক্কার মুশরিকদের নেতা ও কঠোর অত্যাচারী। আল্লাহ তায়ালা তার অত্যাচার-উৎপীড়নের মাধ্যমে মুমিনদের ঈমান পরীক্ষা করেছেন এবং তারা সে পরীক্ষায় সফল হয়েছেন।
আবু জাহেলের ছেলের নাম ইকরামা। রাসূল সা. যখন মক্কার মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানালেন তখন তিনি ছিলেন টগবগে যুবক। বাবার নেতৃত্বে তিনিও রাসূল সা.-এর বিরোধিতায় নামেন। মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান এতোটাই কঠোর ছিল যে, এসব দেখে আবু জাহেল চরম তৃপ্তি অনুভব করতো।
তিনি মক্কার মুশরিকদের পক্ষ নিয়ে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে তাঁর বাবার করুণ পরিণতি হয়। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তিনি উহুদ যুদ্ধও অংশ গ্রহণ করেন। খন্দক যুদ্ধেও তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।
মক্কা বিজয়ের সময়ও ইকরামা মুসলমানদের বিপক্ষে প্রতিরোধ তৈরি করেন। তবে বিখ্যাত সাহাবি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর সামনে তার প্রতিরোধ বুহ্য তছনছ হয়ে যায়। এ সময় ইকরামা প্রাণ বাঁচানোর জন্য সেখান থেকে পালিয়ে যান।
এদিকে রাসূল সা. মক্কা বিজয়ের পর সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও এতোদিন লাগাতার ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে গেছে এমন কিছু লোকের তালিকা করলেন এবং তাদের ক্ষমা না করার কথা জানালেন। এই তালিকায় শীর্ষে ছিল ইকরামার নাম। এই ঘোষণা শোনার পর কোনো উপায়ন্তর না দেখে মক্কা থেকে ইয়ামানের দিকে যাত্রা করলেন ইকরামা।
শিগগিরই ইকরিমা কুফর ত্যাগ তরে মুমিন হিসেবে তোমাদের কাছে আসছে। তোমরা তার পিতাকে (আবু জাহেল) গালি দেবে না। কারণ, মৃতকে গালি দিলে জীবিতদের মনোকষ্টের কারণ হয় এবং মৃতের কাছে তা পৌঁছে না।
এদিকে ইকরামার স্ত্রী উম্মু হাকিম রাসূল সা.-এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং তার স্বামীর জন্য আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে নিরাপত্তা চাইলেন। রাসূল সা. তাঁকে বললেন, সে নিরাপদ।
আরও পড়ুন
রাসূল সা.-এর কাছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাবার পর ইকরামার স্ত্রী তাঁর সন্ধানে বের হলেন। তিহামা নামক অঞ্চলে সমুদ্র উপকুলে তিনি স্বামীকে খুঁজে পেলেন। তিনি ইকরামাকে রাসূল সা.-এর পক্ষ থেকে তাঁকে নিরাপত্তা প্রদানের সুসংবাদ শুনালেন।
ইকরামা স্ত্রীর কাছে এই সংবাদ শুনে আশস্ত হলেন এবং মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি মক্কার কাছাকাছি পৌঁছালে রাসূল সা. সাহাবিদেরকে বললেন—
শিগগিরই ইকরিমা কুফর ত্যাগ তরে মুমিন হিসেবে তোমাদের কাছে আসছে। তোমরা তার পিতাকে (আবু জাহেল) গালি দেবে না। কারণ, মৃতকে গালি দিলে জীবিতদের মনোকষ্টের কারণ হয় এবং মৃতের কাছে তা পৌঁছে না।
ইকরামা রাসূল সা. -এর দরবারে পৌঁছালে রাসূল সা. তাঁর কাছে এগিয়ে এলেন এবং তাঁকে ক্ষমার কথা জানালেন। এ কথা শুনে ইকরামা বললেন—
এ দাওয়াতের পূর্বেই আপনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সত্যবাদী এবং সবচেয়ে সৎকর্মশীল। এরপর তিনি বললে, আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্নাকা আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।
রাসূল সা. ইকরামাকে বললেন, অন্য কাউকে আমি দিচ্ছি এমন কোনো কিছু যদি আজ তুমি আমার কাছে চাও আমি তোমাকে দেব।
ইকরিমা বললেন, আমি আপনার সঙ্গে যত শত্রুতা করেছি, যত যুদ্ধে আপনার মুখোমুখি হয়েছি এবং আপনার যত বিরোধিতা করেছি সবকিছুর জন্য আপনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য মাগফিরাত কামন করুন। আমি এটাই চাই।
রাসূল সা. তখন তার জন্য দোয়া করলেন—
হে আল্লাহ! যত শত্রুতাই সে আমার সঙ্গে করেছে, তোমার নূরকে নিভিয়ে দেওয়ার জন্য যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হতে যত পথই সে ভ্রমণ করেছে, সবকিছু তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা অগোচরে আমার মানহানিকর যত কথাই সে বলেছে তাও তুমি ক্ষমা করে দাও।
রাসূল সা.-এর দোয়ার পর ইকরামার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহর কসম, আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য আমি যত ব্যয় করেছি তার দ্বিগুণ আমি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবো এবং আল্লাহ রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য যত যুদ্ধ করেছি তার দ্বিগুণ যুদ্ধ আমি আল্লাহর রাস্তায় করবো।
এরপর থেকেই তিনি দাওয়াতের মিছিলে প্রবেশ করলেন। হলেন যুদ্ধের ময়দানের অশ্বারোহী, মসজিদে সর্বাধিক ইবাদতকারী, রাত্রি জাগরণকারী ও আল্লাহর কিতাব পাঠকারী। পবিত্র কোরআন মুখের ওপর রেখে তিনি বলতেন,এটা আমার রবের কিতাব, প্রভুর কালাম। একথা বলে আকুল হয়ে কাঁদতেন।
রাসূল সা.-এর কাছে ইকরামা যে অঙ্গীকার করেছিলেন তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানেরা যত যুদ্ধ করেছেন তিনি সবগুলোতেই অংশ গ্রহণ করেছেন।
(আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ১/২০৩)