ছেলেকে গ্র্যান্ডমাস্টার বানাতে নিজ বাসাতেই দাবার ভেন্যু

রায়ান রশীদ মুগ্ধ। ঢাকার সাউথ পয়েন্ট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বয়স মাত্র ৯। একাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে দাবার বোর্ডেই কাটে তার দিন-রাত। ২০১২ রেটিংধারী দাবাড়ু মুগ্ধকে গ্র্যান্ডমাস্টার বানানোর ব্রত নিয়েছেন তার বাবা মাহবুবুর রশীদ। দাবার নিবিড় অনুশীলন ও টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য নিজ বাসাকেই করেছেন দাবার ভেন্যু।
গত বছর সেপ্টেম্বরে পন পাওয়ার চেস ক্লাবের জন্ম। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্ট করেছে ক্লাবটি। এবার সেই ক্লাবের আনুষ্ঠানিক ভেন্যু হয়েছে মুগ্ধদের বাসা। নারায়ণগঞ্জ যেতে ভূইগড় এলাকা পেরিয়ে রুপায়ন টাওয়ার আবাসিক এলাকা। সেই আবাসিক পল্লিতে নিজেদের বাসার একটি কক্ষে পাঁচটি টেবিল। দশ জন দাবাড়ু নিয়ে প্রতিযোগিতা আয়োজনের মতো পরিবেশ করা হয়েছে।
আবাসিক বাসায় দাবা ক্লাব এবং টুর্নামেন্টের পরিবেশ সচরাচর দেখা যায় না। ব্যতিক্রম এই পন্থা অনেকটা বাধ্য হয়েই করেছেন মুগ্ধ’র বাবা মাহবুব রশীদ, ‘আমার ছেলের দাবার প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা। বাবা হিসেবে আমি চাই ছেলে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে স্বপ্ন পূরণ করুক। টাইটেল অর্জন ও রেটিং বাড়াতে হলে বিদেশে যেতে হয়, সেক্ষেত্রে দাবাড়ুদের ব্যয় হয়অনেক অর্থ। আবার দেশে আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার জন্য তেমন টুর্নামেন্টও আয়োজন করে না ফেডারেশন। ফলে খানিকটা অভিনব পন্থায় যেতে হলো।’

বাসার একটি কক্ষ শুধু দাবার জন্য বরাদ্দই করেননি মাহবুব। টুর্নামেন্টের সময় দাবাড়ুদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থাও করেছেন। আবাসিক পল্লিতেই আলাদা একটা বাসা ভাড়া করেছেন যেখানে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ৬-১০ জন দাবাড়ু অবস্থান করে প্রশিক্ষণ ও টুর্নামেন্ট খেলতে পারেন। বেসরকারী চাকরিজীবী মাহবুবের জন্য ব্যয় হলেও এই ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি, ‘একটি টুর্নামেন্ট খেলতে গেলে ১-২ লাখ টাকা লাগে। এখানে জাতীয় বা বিদেশি দাবাড়ুরা আসলে স্বল্প খরচে থাকা-খাওয়া করতে পারবে। এতে তাদের সাশ্রয় হবে। আমি শুধু মুগ্ধ’র জন্য নয়, তার মতো উঠতি আরও অনেক দাবাড়ুও যেন উঠে আসে এজন্যই এটি করেছি।’
নয় বছর বয়সেই মুগ্ধ দাবার বোর্ডে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। দাবা ফেডারেশন আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তিনিন। দেশের বাইরেও ভালো ফলাফল করেছেন। ছেলের উৎসাহ ও যোগ্যতার কারণে ফিদে মাস্টার নাইম হককে কোচ হিসেবে রেখেছেন বাবা। মুগ্ধর বাসায় থেকে কোচিং করানো নাইম বলেন, ‘দাবা খেলা ও অনুশীলনে কোনো ক্লান্তি নেই মুগ্ধ’র। এমনও হয়েছে দিনে দশ ঘণ্টাও দাবা প্র্যাকটিস করেছে। বেশ সম্ভাবনাময় দাবাড়ু। তার বাবার এই উদ্যোগ বেশ সুন্দর ও চ্যালেঞ্জিং ভালোমতো বাস্তবায়ন হলে মুগ্ধ ও উঠতি দাবাড়ুদের অনেক উন্নতি হবে।’
পাঁচটি টেবিল থাকায় পাঁচ বোর্ডে দশ জন দাবাড়ু খেলতে পারবেন। তাদের নিয়ে টুর্নামেন্ট বা প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরিকল্পনা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মাস্টার ও পন পাওয়ার চেস ক্লাবের সভাপতি আবু সুফিয়ান শাকিল বলেন, ‘স্বল্প আয়তন-পরিসর এবং গুরুত্ব বিবেচনায় পেশাদার দাবাড়ুদের জন্যই আমরা ১০ জনের ফরম্যাটের প্রতিযোগিতার চিন্তাভাবনা করেছি। উঠতি দাবাড়ুরা যদি আবাসিক প্রশিক্ষণ নিতে চায়, নির্দিষ্ট ফি’র মাধ্যমে তারা এখানে অনুশীলনেও সুবিধা পাবে।’

আন্তর্জাতিক মাস্টার টুর্নামেন্টে নর্ম অর্জন করতে হলে তিন দেশের খেলোয়াড় প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশীয় ৪ জন আন্তর্জাতিক মাস্টার খেলতে হয়। নারায়ণগঞ্জে মুগ্ধ’র বাসায় আন্তর্জাতিক দাবাড়ুরা আসবেন বলেও আশাবাদী পন পাওয়ার চেস ক্লাবের সভাপতি আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিল, ‘আমাদের দাবাড়ুদের যেমন বিদেশ গিয়ে নর্ম করতে হয় তেমনি বিদেশি দাবাড়ুদেরও। আমি শতভাগ বিশ্বাসী ভারতীয় দাবাড়ু যারা আন্তর্জাতিক মাস্টার হতে চায় তারা অবশ্যই স্বল্প খরচে এরকম টুর্নামেন্টে আসবে। তৃতীয় দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কান দাবাড়ুদের অংশগ্রহণ নিয়ে একটু চিন্তা করছি।’
ফুটবল, ক্রিকেটের মতো দাবাতেও ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার সংস্কৃতি রয়েছে। বাংলাদেশেও এমন অভিযোগ উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ে একজন দাবাড়ুর রেটিং বৃদ্ধি নিয়ে। একজন দাবাড়ুর বাসভবনে আয়োজিত টুর্নামেন্টে তাই নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে খানিকটা প্রশ্ন থেকেই যায়। এক্ষেত্রে পন পাওয়ার চেস ক্লাবের সভাপতির ব্যাখ্যা, ‘আমরা কোনো টুর্নামেন্ট করলে সেটা লাইভ করব এবং আন্তর্জাতিক মানের বিচারকও থাকবে। এখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। টুর্নামেন্ট পন পাওয়ার চেস ক্লাব করলেও ফেডারেশনের সাপোর্টও থাকবে।’
যার জন্য মূলত এই উদ্যোগ সেই মুগ্ধ নিজেও আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হতে চাই। বাবার সহায়তা আমাকে আরও ভালো খেলতে উৎসাহিত করে।’ আগামী তিন-চার বছরকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন মুগ্ধর বাবা, ‘এখন আমার কাছে ছেলের দাবাই বেশি প্রাধান্য। এজন্য স্কুলে শুধু পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তিন-চার বছরের মধ্যে যদি দেখা যায় কাঙ্ক্ষিত বা প্রত্যাশিত অবস্থানে যেতে পারছে না বা সম্ভাবনা নেই, তখন পুরোদস্তুর পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনব। আমার ছেলের প্রতি বিশ্বাস রয়েছে সে দাবাতেই ভালো করতে পারবে।’
ঘরোয়া পরিবেশে দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন নারায়ণগঞ্জে নব্বইয়ের দশকেও হয়েছে। তবে তখন এতটা সুসজ্জিত ছিল না। মুগ্ধর পরিবারের উদ্যোগটি বেশ প্রশংসনীয়। আগামীর দিনগুলোতে বাস্তবিকভাবে টুর্নামেন্ট আয়োজন করে মুগ্ধ ও উঠতি বাচ্চারা কতটুকু উপকৃত হয় সেটাই দেখার বিষয়।
এজেড/এএইচএস