‘ঢাবির ক্রীড়াঙ্গনের সিন্ডিকেট ভাঙতে চাই’

ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে উঠেছেন লামিয়া আক্তার লিমা। এরপরের গল্পটা অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণার হতে পারে। পেশাদার হকি খেলছেন, পড়াশোনা করছেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কদিন আগে অনুষ্ঠিত হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামসুন্নাহার হল সংসদের বহিরঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়াঙ্গনের দুর্নীতি, খেলোয়াড় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম, খেলার সরঞ্জাম ও দলীয় দখলদারিত্ব মুক্ত করে ক্রীড়াঙ্গনকে সুস্থ ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে গড়ে তুলতে চান লামিয়া আক্তার লিমা। তার শেকল ভাঙার গল্প শুনেছেন ঢাকা পোস্টের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি রেদওয়ান মিলন।
ঢাকা পোস্ট : আপনি কেমন আছেন?
লামিয়া : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
ঢাকা পোস্ট : আপনি পেশাদার হকি খেলোয়াড়। কিভাবে হকি খেলা বেছে নিলেন এই গল্পটা শুনতে চাই...
লামিয়া : ছোটবেলা থেকেই মূলত খেলার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। যখন হাইস্কুলে পড়াশোনা করি ৬ষ্ঠ শ্রেণীর শেষ দিকে হয়তো হবে। ঠাকুরগাঁও সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক আবু ইয়াসিন মো. মাসুদ রানা স্যার আমাকে প্রথমে মাঠে নিয়ে আসেন এবং হকি খেলা শেখান। সেখান থেকে প্রথমে আমার উপঞ্চল পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হয়। দ্বিতীয় বার আমি জাতীয়ভাবে রানার্স-আপ হই। এভাবে হকিতে আমার ধারাবাহিকতা শুরু হয়। এটার মূল কারিগর রানা স্যারের হাত ধরেই এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি।

ঢাকা পোস্ট : জাতীয় পর্যায়ে কতদিন খেললেন?
লামিয়া : জাতীয় পর্যায়ে খেলেছিলাম বেশ কিছুদিন। আমাদের জাতীয় পর্যায়ে যে ক্যাম্পগুলো হতো ২০১৬-১৭ সালের দিকে, তৃণমূলের জাতীয় ক্যাম্পগুলো চালু করেছিল ওখানে পরপর দুইবার ছিলাম। তবে দুর্ভাগ্যবশত কারণে নিজের স্থানটা ধরে রাখতে পারিনি।
ঢাকা পোস্ট : ঠিক কী কারণে?
লামিয়া : মোটাদাগে বললে প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল।
ঢাকা পোস্ট : আমাদের দেশে মেয়ে ক্রীড়াবিদদের খেলা কিংবা তাদের জার্সি নিয়ে অনেকের অনেক কটুকথা শুনতে হয়। আপনার ক্ষেত্রে কী এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল?
লামিয়া : খেলাধুলা যখন থেকে শুরু করেছি পরিবারের কাছ থেকে অনেক সমর্থন পেয়েছিলাম। তারা আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়ে আসছে। পরিবারের কাছ থেকে এমন সহযোগিতা পাবার পর যখন রাস্তায় বের হই সে পথটা সহজ ছিল না। বাবা-মা আমার কাজগুলো সমর্থন করলেও পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অনেক কটুকথার শিকার হয়েছি। তারা আমার পোশাক ও চলাফেরা নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে প্রতিনিয়তই। তবে আমি এসব কটু কথা রুখে দিয়ে পরবর্তীতে আমার জায়গায়টা ধরে রেখেছি।
ঢাকা পোস্ট : এখন আপনি কী খেলছেন?
লামিয়া : আমি হকি খেলা মূলত শুরু করার পরে আমাদের আরও যে টুর্নামেন্টগুলো হয় যেমন খো খো, বাস্কেটবল ও ফুটবল অনেক ইভেন্ট করেছি। তার মধ্যে খো খো টুর্নামেন্ট খেলার পরে আমাদের বাছাই হয় সেখান থেকে আমি খো খো ন্যাশনাল ক্যাম্পে সুযোগ পাই এবং সুযোগ পাবার পর ২০২৩-এ আমাদের এশিয়া কাপ অনুষ্ঠিত হয় ওই ক্যাম্পে আমি সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও পাসপোর্ট জটিলতার কারণে যেতে পারিনি।
ঢাকা পোস্ট : এখন তাহলে কী খেলছেন?
লামিয়া : কয়েক দিন আগেই শেষ হলো ৯ম জাতীয় খো খো টুর্নামেন্ট। আনসার দলের হয়ে আমি মাঠে লড়েছি।
ঢাকা পোস্ট : প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা লামিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধ কেমন ছিল?
লামিয়া : ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ বলা যায় আল্লাহর রহমতেই। কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই আমি আবেদন করেছিলাম। আবেদনের পর যখন আমাদের ভাইবা হয় তখন আমি অসুস্থ ছিলাম। পায়ে ইঞ্জুরি ছিল। ঐ অবস্থাতে আমি ভাইবা পরীক্ষা দেয়। পরিক্ষা দেওয়ার পরদিন রেজাল্ট আসে যে আমি ভর্তির সুযোগ পেয়েছি, তবে আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি স্বপ্নেও কোনোদিন চিন্তা করিনি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করব।

ঢাকা পোস্ট : মফস্বলের মেয়ে হয়ে ডাকসুর মত জায়গায় ভোট করার ইচ্ছেটা কিভাবে হলো?
লামিয়া : মূলত আমি খেলোয়াড় কোটায় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। হলসহ প্রত্যেক খেলায় আমি অংশগ্রহণ করি। আমি যখন দেখলাম যে ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এখানে একটা পথ রয়েছে ক্রীড়া সম্পাদকের। আমি চিন্তা করলাম যেহেতু আমি হলের প্রত্যেক খেলায় অংশ নেই। সেক্ষেত্রে আমি জানি খেলায় কোন কোন বিষয়গুলো জটিল বা প্রয়োজন। এই ঘাটতিগুলো পূরণ করার জন্য হল খেলার মানোন্নয়নের জন্য আমি চিন্তা করলাম এই পদে আমি নির্বাচন করব এবং এটার মাধ্যমে আমি নিজেকে যেমন যাচাই করতে পারব তেমন খেলার মানোন্নয়নের সুযোগ পাবো। এটার পরিপ্রেক্ষিতে আমি নির্বাচন করার উদ্যোগ নেই। আমার শামসুন্নাহার হল। এখানে আবাসিক ৪ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। আমি যখন ঘোষণা দেই যে শামসুন্নাহার হল সংসদের বহিরঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক পদে আমি নির্বাচন করব তখন হলের সবাই আমাকে সমর্থন দেয়। আমার প্রতি হলের সকলের ভালোবাসা ও সমর্থন ছিল বলেই কেউ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়নি। তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামসুন্নাহার হল সংসদের বহিরঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হই।
ঢাকা পোস্ট : নির্বাচিত তো হলেন, আগামী এক বছরে কী কী পরিকল্পনা রয়েছে আপনার?
লামিয়া : আমাদের হলগুলোতে মূলত নারীদের খেলার সরঞ্জাম, দক্ষ প্রশিক্ষকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া তৃণমূল থেকে যারা নতুন খেলোয়াড় আসছে তাদের গাইড দেয়া প্রয়োজন। হলে একটা জিমনেসিয়াম প্রয়োজন। যেহেতু মেয়েদের ফিটনেসের একটা ঘাটতি থেকে যায়, মেয়েরা সারাদিন পড়াশোনা করে পড়াশোনার ফাঁকে নিজের ওয়ার্কআউট করতে পারে না। এজন্য জিমনেসিয়ামটা খুবই প্রয়োজন। আমি এই অভাবগুলো পূরণ করতে চাই। আমাদের শিক্ষার্থীদের যে দাবি দাওয়া আছে সেগুলো ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করতে চাই। আমি চাই এ চাহিদাটা তুলে ধরে শিক্ষার্থীদের মাঝে খেলাবান্ধব যে একটা পরিবেশ তাহলে নিয়ে আসতে পারব ইনশাল্লাহ। বিশেষ করে গত বছরগুলোতে দেখেছি ক্রীড়াঙ্গনের যে দুর্নীতি, খেলোয়াড় বাছাইয়ে অনিয়ম, খেলার সরঞ্জাম ও দলীয় দখলদারিত্বের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনকে সুস্থ ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে গড়ে তুলতে চাই।
ঢাকা পোস্ট : দেশের নারী হকি নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
লামিয়া : হকি দিয়েই আমার খেলাধুলার জীবন শুরু। তার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আমি খো খো খেলছি। আমি বলতে চাই হকি প্রগতিশীল গেইম হলেও আমাদের দেশের হকি নারীদের অবস্থানটা অনেকটা নিম্ন। ফেডারেশন নারী খেলোয়াড়দের ওভাবে দেখছে না। নারীদের ওপর তারা ভরসা করছে না। নারীদের পরিচর্যা নেওয়া হচ্ছে না। আমি চাই ফেডারেশন এগুলোর তাদের তত্বাবধানে নিক এবং আমাদের ইউনিভার্সিটি গুলোতে হকি ও খো খো খেলায় অংশ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হোক। নারীদের যে খেলাধুলা, নারীরা যে এত কস্ট করে, পরিশ্রম করে খেলাধুলা করছে তারা যেন ওই জায়গায়গুলোতে পৌঁছাতে পারে এবং জীবনে খেলাধুলার মাধ্যম হলেও যেন রাষ্ট্রের বড় বড় ভূমিকাগুলো পালন করতে পারে।
এফআই