চাঁদপুরের ১০ জমিদার বাড়ি
পুরোনো বাড়ি কিংবা স্থাপনা, এসবের প্রতি আমার রয়েছে ভালোবাসা। কোনো জেলায় ঘুরতে গেলে সেখানকার জমিদার বাড়িগুলো ঘুরে দেখার চেষ্টা করি। প্রতিটা জেলাতেই জমিদার বাড়ি আছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই আইকনিক কিছু জমিদার বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ির তথ্য জানেন না।
ফলে নিজেকেই তথ্য সংগ্রহ করে যেতে হয়। এবারের উদ্দেশ্য চাঁদপুর। অনেকে মনে করেন, চাঁদপুরে রূপসা জমিদার বাড়ি আর ত্রিমোহনা ছাড়া দেখার কিছু নেই। অথচ আমি নিজেই চাঁদপুরের দশটা জমিদার বাড়ির সন্ধান পেয়েছি, হয়ত আরো থাকতে পারে, নাও পারে। চলুন সেসব জমিদার বাড়ি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
লুধুয়া জমিদার বাড়ি
প্রথমদিন গিয়েছিলাম উত্তর মতলব উপজেলার লুধুয়া জমিদার বাড়িতে। এ বাড়িটা মিয়াজি বাড়ি নামেও পরিচিত। উত্তর মতলব উপজেলার লুধুয়া গ্রামে এর অবস্থান। এই জমিদারবাড়ির মালিক ছিলেন ছিরাপদি মিয়াজি। তিনি ১৭০০ শতকের মাঝামাঝি এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন খুব অত্যাচারী জমিদার এবং একইসাথে শৌখিন। তিনি শখের বশে অনেকগুলো ঘোড়া পুষতেন। উত্তর মতলব উপজেলার অধিকাংশ জায়গাই তার দখলে ছিল। বর্তমানে তার বংশের উত্তরাধিকারীরা সেখানে বসবাস করেন। বাড়িটার প্রায় ভগ্নদশা। দুটো ভবন কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি ভবনগুলো ভেঙেচুরে নিজেদের মতো সংস্কার করে থাকছেন বাসিন্দারা। যে দুটো ভবন এখনো কোনোরকমে টিকে আছে, তাতে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার পরিবেশ, বাঁদুর ওড়াউড়ি করছিলো। বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার পর তারা আন্তরিকভাবে ঘুরে দেখার অনুমতি দিয়েছিলেন। বাড়িটার সৌন্দর্য এখন বিলীন হয়ে গেছে। তবুও যাদের জমিদার বাড়ি দেখার প্রতি তীব্র আগ্রহ আছে, তারা চাইলে বাড়িটা ঘুরে আসতে পারেন। বাড়িটা মূল সড়কের পাশে অবস্থিত নয়, অল্প একটু ভেতরে। স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দিবে।
আরও পড়ুন : যেভাবে যাবেন বিরুলিয়া জমিদার বাড়ি
বোয়ালিয়া জমিদার বাড়ি
লুধুয়া জমিদার বাড়ি দেখা শেষ হওয়ার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল দক্ষিণ মতলব উপজেলার বোয়ালিয়া জমিদার বাড়ি। সিএনজি যোগে আমরা চলে গেলাম সেখানে। দক্ষিণ মতলব উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে এই জমিদার বাড়িটির অবস্থান। ১৭৯৩ সালে বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বাড়িটির মালিক রায় মজুমদার ও দে চৌধুরি। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী সময়ে মহববতপুর গ্রামের রায় মজুমদার ও বোয়ালিয়া গ্রামের দে চৌধুরি মিলে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। তারা একসাথে জমিদারিত্ব করেন। দানশীল ও উদারমনা জমিদার হিসাবে তাদের খুব সুনাম ছিল। মসজিদ ও মন্দির নির্মাণ করার জন্য জায়গা দান করেছিলেন। এছাড়াও একাধিক বিদ্যালয়, বাজার ও ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করেন তারা। এ জমিদার বাড়িটা একটু ভেতরে, খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়েছে। এখানেও মোটামুটি সংস্কার করে মানুষজন থাকে, তবে দেখে যা বুঝলাম জমিদার বাড়িটি খুব বিস্তৃত পরিসরে ছিল, বর্তমানে তার অধিকাংশই বিলীন হয়ে গেছে, এদিক সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জমিদার বাড়ির ভগ্ন কিছু চিহ্ন। এ বাড়ির একজন উত্তরাধিকারের সাথে কথা বলে খুব ভালোলাগলো। তিনি জানালেন, তাদের বংশের প্রায় সবাই কলকাতা চলে গেছেন দেশভাগের পর, তারা এখনো ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন। জমিদারবাড়ির শানবাঁধানো পুকুরঘাটে বসলাম আমরা, তুলসিতলা দেখলাম আর অতীত চারণ করলাম।
বোয়ালিয়া জমিদার বাড়িতে যাওয়ার পথে আমরা একটা সুন্দর পুরোনো বড় বাড়ি দেখেছি। বাড়িটার নাম পাটোয়ারী বাড়ি। অনেকে এটাকেই বোয়ালিয়া জমিদার বাড়ি হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু স্থানীয়দের সাথে কথা বলে আমরা সঠিক তথ্য পেয়েছি।
বলাখাল জমিদার বাড়ি
দ্বিতীয় দিনে আমরা গিয়েছিলাম চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার বলাখাল গ্রামের বলাখাল জমিদার বাড়ি। উনিশ শতকের প্রথমদিকে এই জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা যোগেন্দ্র রায় নারায়ণ চৌধুরি। ১২.৫১ একর জমির ওপর এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে। দানশীল জমিদার হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল। বলাখাল জে এন উচ্চ বিদ্যালয় ও রেল লাইনটি তাদেরই দান করা জায়গায় বানানো হয়েছিল। ইতিহাসে এই জমিদার বংশের তিনজন ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। তারা হলেন, জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা যোগেন্দ্র রায় নারায়ণ চৌধুরি এবং তার দুই সন্তান সুরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি ও দেবেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরি।
আরও পড়ুন : কম খরচে আমিয়াখুম যাবেন যেভাবে
হাজীগঞ্জ সদর থেকে আমরা যখন সিএনজি যোগে বলাখাল জমিদার বাড়িতে যাচ্ছিলাম, তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। গল্প, গানে আর বৃষ্টির তালে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম গন্তব্যে। বেশিরভাগ জমিদার বাড়িই একটু বিদঘুটে এলাকায় থাকে, পৌঁছাতে বেগ পোহাতে হয়, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ফেরার পথে পরিবহণ না পাওয়ার আশঙ্কায় প্রায় সব জমিদার বাড়িতেই আমরা রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে গিয়েছি। বৃষ্টির ভেতর জমিদার বাড়িটা খুঁজে বের করতে একটু কষ্ট হলেও পৌঁছানোর পর জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য দেখে সব ভুলে গেলাম। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ ছিল না, তাই আমরা বৃষ্টির ভেতরেই ঘুরেছি, ছবি তুলেছি। তবে আমরা জমিদার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। সেখানে মানুষ বসবাস করে, সবাইকে প্রবেশের অনুমতি দেয় না। বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বুঝেছি ভেতরে আরো সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। তা বাদেও বাইরে থেকে যা দেখেছি, তাইবা কম কীসে। আরো একটা ব্যাপার না বললেই নয়, এই জমিদার বাড়ির সামনে চারটা মূর্তি রাখা ছিল, সেই মূর্তি চারটার কারুকাজ এত নিখুঁত আর সুন্দর, তা আমার দীর্ঘজীবন মনে থাকবে। কোনো দেবীর মূর্তি দেখে আগে কখনো এতটা মুগ্ধ হয়েছি বলে মনে পড়ে না!
বড়কূল জমিদার বাড়ি
এ বাড়িটি হাজীগঞ্জ উপজেলার বড়কূল গ্রামে অবস্থিত। স্থানীয়দের কাছে এটি ভাগ্যিতা বাড়ি নামেও পরিচিত। মুঘল স্থাপত্যশৈলী রীতিতে এ বাড়িটি তৈরি করা হয়। এই বাড়িটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার পদ্মলোচন সাহা।
প্রায় চার একর জায়গা নিয়ে এ বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। পদ্মলোচন সাহা ছিলেন খুবই শৌখিন জমিদার, তা তার বাড়ির স্থাপত্যশৈলী দেখলেই বোঝা যায়। লোকমুখে শোনা যায়, পুকুরে গোসল করতে গেলে জমিদারের মায়ের পায়ে কাদা লাগবে ভেবে পুকুরের তলদেশ তিনি পাকা করে দিয়েছিলেন। এখন এই জমিদার বাড়িতে জমিদার বংশের উত্তরাধিকারীরা বসবাস করেন। তারা বাড়িটিকে যত্ন করে রেখেছেন বলে বাড়িটি এখনো খুব সুন্দর।
বলাখাল জমিদার বাড়ি থেকে আমরা প্রথমে জিয়ানগর যাই। তখনো বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। জিয়ানগর থেকে স্থানীয় একটা বাস নিই রিজার্ভ। এ জমিদার বাড়িটি আরো বেশি প্রত্যন্ত এলাকায়, তবু আমরা জলকাদার ভেতর ঠিক পৌঁছে যাই সেখানে। বৃষ্টির জন্য যেন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো তাড়াতাড়ি, যদিও তখন সবে দুপুর। তাছাড়া এলাকা এত ভেতরে, সবুজ গাছপালাবেষ্টিত বনজঙ্গলের মতো জায়গায়, তাই আরো অন্ধকার মনে হচ্ছিলো। তুলনামূলক অল্প সময়ের ভেতর বাড়িটা ঘুরে দেখলাম আমরা। সেই সুন্দর পুকুরঘাটে বৃষ্টির ভেতর কিছুক্ষণ বসে রইলাম। এত অবর্ণনীয় ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম, বলার মতো নয়। ফেরার সময় জমিদার বাড়ির মতো দেখতে আরেকটা পুরোনো বাড়ি ঘুরে দেখে এলাম। তারপর জঙ্গলময় পরিবেশ ছেড়ে মূল সড়কে চলে এলাম, যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব। জমিদার বাড়িগুলোতে ঘুরতে গেলে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যেন সন্ধ্যের আগেই সেই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে আসা যায়, নাহলে কোনো বিপদ হলেও হতে পারে। আর এমন ধরনের আবহাওয়া হলে সেখানে না যাওয়াই মঙ্গল।
রূপসা জমিদার বাড়ি
হাজীগঞ্জ থেকে সিএনজি নিয়ে এরপর আমরা চলে যাই ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৫ নং রূপসা উত্তর ইউনিয়নের রূপসা জমিদার বাড়িতে। চাঁদপুরের মানুষ কিংবা বাইরের মানুষ চাঁদপুরের জমিদার বাড়ি বলতে শুধু এই রূপসা জমিদার বাড়িটাকেই চেনে। এটা সবচেয়ে বেশি আইকনিক। আর এটাই চাঁদপুরের একমাত্র জমিদার বাড়ি, যার অবস্থান জনবহুল জায়গায়, একদম রূপসা বাজারের পাশে। বলা বাহুল্য যে, পুরোটা দিন কেটে গেলো বৃষ্টিতে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই আমরা পৌঁছে যাই রূপসা জমিদার বাড়িতে। সেখানে পৌঁছানোর পর বৃষ্টি থেমে গেলেও আবহাওয়া গুমোট বেঁধে ছিল।
রূপসা জমিদার বাড়িটি ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ করা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আহম্মদ রাজা চৌধুরি। দেশের বেশিরভাগ জমিদারবাড়ির যখন ভগ্নদশা, তখন চাঁদপুরের এই জমিদার বাড়িটি সংস্কার করে এখনো প্রায় আগের মতোই সুন্দর করে রাখা হয়েছে। চাঁদপুরের বাকি জমিদারবাড়ি অবস্থা এটার মতো এতটা সুন্দর নয়। এজন্যেই হয়ত এই বাড়িটা সবচেয়ে আইকনিক। প্রায় ২৫০ বছর আগে বংশাল গ্রামের, বর্তমান খাজুরিয়া গ্রামের হিন্দু জমিদারদের জমিদারির পতন হলে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই জমিদারি কিনে নেন আহম্মদ রাজা চৌধুরি এবং তিনি রূপসা জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন; যদিও এই জমিদার বাড়ির মূল প্রতিষ্ঠাতা কে তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
আরও পড়ুন > জাদিপাই ঝর্ণা : যেভাবে যাবেন, সঙ্গে যা নেবেন
এ জমিদার বাড়ির মানুষেরা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকভাবে সাহায্য করেছিলেন। তারা প্রজাদের কখনো খাজনার জন্য চাপ দিতেন না, বরং সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকতেন। এখন এই বাড়িতে তাদের উত্তরাধিকারীরা বসবাস করে। এখানে এখনো তিনটি ভবন আছে, কাচারি ঘর, মসজিদ, কবরস্থান ও পুকুরপাড় আছে। এত সুন্দর সবকিছু সাজানো গোছানো, দেখলে মনে হবে এখনো এখানে জমিদাররা রয়ে গেছেন আড়ালে আবডালে।
কড়ৈতলী জমিদার বাড়ি
ফরিদগঞ্জ উপজেলার আরো একটি জমিদার বাড়ি হচ্ছে কড়ৈতলী জমিদার বাড়ি। সন্ধ্যার আগে আমাদের আজকের মতো শেষ গন্তব্য ছিল কড়ৈতলী জমিদার বাড়ি। রূপসা জমিদার বাড়ি থেকে সিএনজি নিয়ে আমরা গেলাম সেখানে, দূরত্ব বেশি নয়। কড়ৈতলী বাজারের দক্ষিণ কোণের পশ্চিম দিকে অবস্থিত এই জমিদার বাড়ি। স্থানীয় মানুষদের কাছে এ বাড়িটি বাবুর বাড়ি নামেই বেশি পরিচিত। বরিশাল জেলার অধিবাসী হরিশ চন্দ্র বসু।
বাংলা ১২২০ সালে এই কড়ৈতলী জমিদার বাড়িটির গোড়াপত্তন করেন। তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকাররা জমিদারির দায়িত্ব পালন করেন। এই জমিদাররা ছিলেন অনেক অত্যাচারী। এই জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে সাধারণ মানুষ জুতা পায়ে দিয়ে ও ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটতে পারতো না। ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর ইংরেজি ১৯৪৮ সালে এ বাড়ির সবাই পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলায় চলে যান।১৯৫১ সালে শেষ জমিদার গোবিন্দ বসুর হাত ধরেই এই জমিদার বাড়ির পতন ঘটে।
এ জমিদার বাড়িটিও অনেকটা পাণ্ডববর্জিত ধরনের এলাকায়। জমিদার বাড়ি ঘিরে এখন ভূতুড়ে পরিবেশ, অথচ একসময় তাদের কত দাপট ছিল। আগে এখানে তিনটি ভবন ছিল, দুর্গামন্দির ছিল, শানবাঁধানো ঘাটসহ বড় একটা দিঘী ছিল, আরো ছিল দরবার হল। কড়ৈতলী বাজারেও তারা একটা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এ বাড়িতে একটা সুড়ঙ্গপথও ছিলো আত্মগোপন করার জন্য, গুপ্তধন রাখার জন্য ছিল বিশেষ ঘর, যা আঁধার মানিক হিসাবে পরিচিত। এখন পুরো বাড়ির ভগ্নদশা। দেয়ালজুড়ে শ্যাওলা আর নাম না জানা গাছের ছড়াছড়ি। ভবনের ভেতরেও জঙ্গলময় পরিবেশ। সন্ধ্যেবেলায় কড়ৈতলী বাজার থেকে সিএনজি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে।
শোল্লা জমিদার বাড়ি
তৃতীয় দিন আবার আমরা ফরিদগঞ্জ গেলাম শোল্লা গ্রামের শোল্লা জমিদার বাড়ি দেখার জন্য। স্থানীয়দের কাছে এটি চৌধুরি বাড়ি হিসাবে অধিক পরিচিত। শোল্লা জমিদার বাড়িটি বাইরে থেকে দেখতে বেশ সুন্দর, ভেতর দিকটা সাদামাটা। সংস্কার করার দরুন এখনও একদম নতুন লাগে দেখতে, তবে শুধু একটা ভবনই দেখতে পেলাম সংস্কার করা, বাকিগুলো সংস্কার করা হয়নি, কোনোমতে টিকে আছে ভেঙেচুরে। বাড়ির গায়ে ঝুলানো চিঠির একটা লাল রঙের টিনের বাক্স আমাকে মুগ্ধ করলো। বৃষ্টি আজকের দিনেও আমাদের পিছু ছাড়লো না।
আনুমানিক ১২৮১ কিংবা ১২৯৭ বঙ্গাব্দের মধ্যে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে কার দ্বারা এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয় তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও এই জমিদার বংশের কয়েকজন জমিদারের নাম পাওয়া যায় শোল্লা স্কুল অ্যান্ড কলেজ এর ওয়েবসাইট থেকে। তারা ৪৭ শতাংশ জমি দান করেছিলেন স্কুলটি নির্মাণের জন্য। যাদের নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন জমিদার আব্দুল ছমেদ চৌধুরি, নোয়াব আলী চৌধুরি, ইউছুফ আলী চৌধুরি, মোহাম্মদ আবদুল গফুর চৌধুরি ও মোহাম্মদ হানিফ চৌধুরী। এ বাড়িতে এখনো মানুষ বসবাস করে, তবে তারা জমিদারদের উত্তরাধিকার কিনা তা জানা যায়নি।
লোহাগড় জমিদার বাড়ি
ফরিদগঞ্জ উপজেলার আরো একটা জমিদার বাড়ি হচ্ছে বালিয়া ইউনিয়নের লোহাগড় গ্রামের লোহাগড় জমিদার বাড়ি। আমরা মূলত লোহাগড় মঠ দেখার জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে এই জমিদার বাড়ি সম্পর্কে কোনো তথ্য পাইনি। সেখানে গিয়ে দেখলাম জমিদার বাড়িও আছে। তবে সেই ভাঙাচোরা জমিদার বাড়িতে চলছিলো একটা বিয়ের আয়োজন। তাই বাইরে থেকে যতটুকু দেখা সম্ভব, সেটুকুই দেখেছি। লোহাগড় মঠটা জমিদার বাড়ির অদূরেই। মঠটা আমরা ভালোভাবে দেখেছি। প্রায় চার থেকে সাত শতাব্দী পুরাতন প্রাচীন এই মঠ লোহাগড় গ্রামে ডাকাতিয়া নদীর পাশে অবস্থিত, যা লোহাগড় জমিদার বাড়ির জমিদাররা তৈরি করেছিলেন। লোহাগড় জমিদার বাড়ির দুজন জমিদারের নাম ছিল লৌহ এবং গহড়। তাদের নামানুসারেই লোহাগড় হিসাবে পরিচিতি লাভ করে সেই জায়গা এবং মঠ। প্রায় চার থেকে সাতশ বছর পূর্বে তারা এখানে জমিদারি করতেন। তারা খুব অত্যাচারী রাজা ছিল। তাদের ভয়ে কেউ রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কোনোপ্রকার শব্দ করতো না। এখন সেই রাজত্বের তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। দুটো অনেক বড় প্রাসাদ নিয়ে ছিলো লোহাগড় জমিদার বাড়ি। তাদের বাড়ির অবস্থানের নির্দেশিকাস্বরূপ সুউচ্চ মঠ নির্মাণ করা হয়। শুরুতে এখানে পাশাপাশি পাঁচটি মঠ ছিল, তবে বর্তমানে এখানে মাত্র তিনটি মঠ অবশিষ্ট রয়েছে। তাদের আর্থিক প্রতিপত্তির নিদর্শনস্বরূপ তারা মঠের শিখরে একটি স্বর্ণদন্ড স্থাপন করেছিলেন। কথিত আছে, জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর ওই স্বর্ণের লোভে মঠের শিখরে উঠার অপচেষ্টায় অনেকে গুরুতর আহত হয়। শুধু তা-ই নয়, কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে বলেও শোনা যায়।
চাঁদপুরের আরো দুটো জমিদার বাড়ির সন্ধান পেয়েছিলাম আমরা। একটা চান্দ্রা ইউনিয়নের হরিপুর রাজবাড়ি, আরেকটা শাহরাস্তি উপজেলার সাহাপুর গ্রামের সাহাপুর রাজবাড়ি। হরিপুর রাজবাড়িটা আমরা খুঁজে পাইনি। যেহেতু জমিদার বাড়ি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না বা ধারণা রাখে না, তাই বাড়িগুলো খুঁজে পেতে একটু কঠিন হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবারো হরিপুর রাজবাড়িটা খুঁজে দেখবো। সময়ের অভাবে শাহরাস্তি উপজেলায় যাওয়া হয়নি এ যাত্রায়। সুযোগ হলে পরেরবার শাহরাস্তির সাহাপুর রাজবাড়িটা ঘুরে আসবো।
জমিদার বাড়িগুলোতে ভ্রমণ করতে চাইলে বাস এ করে যাতায়াত করা যায় না, সিএনজি বা অটো নিতে হয়, তাও আবার রিজার্ভ। তাই অনেক টাকা খরচ হয়। সেক্ষেত্রে পাঁচ ছয় জনের একটা টিম হলে খরচ অনেকটা কমে আসে। ঢাকা থেকে নদী ও সড়কপথে চাঁদপুর যাওয়া যায়। সদরঘাট থেকে লঞ্চে কিংবা গুলিস্তান থেকে বাস এ করে যাওয়া যায়। ঘণ্টা তিন চারেক সময় লাগে যেতে।
চাঁদপুর শহরে থাকার জন্য কিছু হোটেল আছে। যেমন, মেঘনা রিসোর্ট, হোটেল গ্রান্ড হিলিশা, হোটেল আল রাজিব, হোটেল গাজী, হোটেল তাজমহল, হোটেল শ্যামলী, হোটেল জোনাকি, হোটেল শেরাটন ইত্যাদি।
জমিদার বাড়ি ছাড়াও চাঁদপুরে আরো কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সদরে রয়েছে ত্রিমোহনা, ডিসির বাংলো, রক্তধারা, ইলিশ চত্বর, শপথ চত্বর, অঙ্গীকার ইত্যাদি। কচুয়া উপজেলায় রয়েছে এ.পি কমপ্লেক্স, তুলাতুলী মঠ। ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা ইউনিয়নে আছে সাহেবগঞ্জ নীলকুঠি। শাহরাস্তি উপজেলায় আছে রাগৈ মুঘল আমলের তিন গম্বুজ মসজিদ, পঞ্চগ্রাম/নাওড়া/সত্যরাম মজুমদার মঠ ইত্যাদি। সঠিক পরিচর্যা করলে চাঁদপুরও হয়ে উঠতে পারে পর্যটন নগরী কিংবা জেলা।
এখনো দেশজুড়ে যেসব রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সরকারি উদ্যোগে তা সংরক্ষণ করা খুব দরকার, নাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিজ চোখে দেখতে পাবে না, অনেক ইতিহাস তাদের অজানা থেকে যাবে। এ বিষয়ে সবার সচেতনতা কামনা করছি।