মেঘের সঙ্গে দুই দিন: মিরিঞ্জা ভ্যালির গল্প

ভ্রমণ গল্পগুলো ছোট করে লিখে রাখা ভালো। খুব বড় কোনো কীর্তি নয়। তবুও এই ছোট ছোট লেখাগুলোই একদিন হয়ে ওঠে সময় ছুঁয়ে দেখার জানালা। কখনো নিজের জন্য, কখনো আবার অন্য কারো কাজে লাগবে- এই আশাতেই কলম ধরা।
এই যাত্রায় আমাদের গন্তব্য ছিল বান্দরবানের লামায় অবস্থিত এক অপূর্ব পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্র ‘মিরিঞ্জা ভ্যালি’। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফুট উঁচুতে এই ভ্যালির অবস্থান। বান্দরবান শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ৮৬ কিলোমিটার, আর চকরিয়া থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার।
বর্তমানে জায়গাটি নিয়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে পর্যটকদের মাঝে। মিরিঞ্জার আলাদা একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। এই পাহাড়ের মূল আকর্ষণ হলো ‘মেঘ’। সারাদিনই এখানে মেঘের লুকোচুরি খেলা চলে।

ভোরবেলায় মনে হয়, মেঘ যেন আপনার কানে কানে কিছু বলতে চায়। সকালে মনে হবে- মেঘগুলোর মন আজ দারুণ ভালো, তাই তারা দুষ্টু বাচ্চার মতো ছুটোছুটি করছে। দুপুর গড়ালে মনে হবে- মেঘগুলো যেন খুব তাড়াহুড়ায় কোথাও যাচ্ছে। আর বিকেলে? তখন মনে হবে, মেঘ আপনাকে ছেড়ে দূরে চলে গেছে, তবে যাওয়ার আগে আকাশে নিজের চিহ্ন রেখে গেছে।
এই পাহাড়ে রাত কাটানো ভ্রমণকে নিয়ে যায় একেবারে অন্য মাত্রায়। পাহাড়ের রাতের সৌন্দর্য আসলে লিখে বোঝানো যায় না। মাথার ওপর বিশাল আকাশ, অসংখ্য তারা আর একটা বড় চাঁদ, সব মিলিয়ে এক ধরনের নীরব মুগ্ধতা কাজ করে।
তবে স্পষ্ট করে বলি, যারা ফাইভ স্টার হোটেলের আরাম ছাড়া ভ্রমণ ভাবতেই পারেন না, এই জায়গা তাদের জন্য নয়। এখানে সবই সৌরবিদ্যুতে চলে। বিদ্যুৎ থাকে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত। ঋতু বুঝে আসতে পারলে দিনে গরম লাগবে না, বাতাস থাকবে দারুণ। আর পাহাড়ের রাত বেশিরভাগ সময়ই ঠান্ডা।
মিরিঞ্জা সাজেকের মতো কিনা—এই প্রশ্নে আমি মত দিতে অপারগ। কারণ সাজেক আমার দেখা হয়নি। তবে সাজেকে না গিয়ে মিরিঞ্জা আসার মূল কারণ ছিল একান্ত নিরিবিলি পরিবেশ আর মেঘের সঙ্গ নিরব গল্প করার সুযোগ।

যাতায়াতের গল্প
আমরা ঢাকা থেকে ইউনিকের নন-এসি বাসে চড়েছিলাম। ভাড়া জনপ্রতি ৯৫০ টাকা। বাসে নেমেছি চকরিয়া বাজারে। সেখান থেকে অটোরিকশায় ইয়াংছা- ভাড়া ২০০ টাকা। এরপর সিএনজি করে মিরিঞ্জা বাজার, জনপ্রতি ৫০ টাকা। শুনতে একটু ঝামেলার মতো লাগলেও সকালের নরম রোদ আর জ্যামহীন রাস্তায় পথটা বেশ আরামেই কেটে যায়। চাইলে চকরিয়া থেকে সরাসরি সিএনজি রিজার্ভ করেও আসা যায়, তবে খরচ একটু বেশি পড়বে।
চকরিয়া থেকে মিরিঞ্জা বাজার পৌঁছাতে আমাদের সময় লেগেছে প্রায় এক ঘণ্টা। আরও সহজ পথ নিশ্চয়ই আছে, তবে জায়গাটা আমাদের জন্য নতুন হওয়ায় সে পথে যাইনি।

মিরিঞ্জা বাজার থেকে রিসোর্টে পৌঁছাতে লাগে আরও ২০ মিনিটের মতো। হালকা ট্রেকিংয়ের ফিল। আমার তিন বছরের মেয়ে অতি উৎসাহে পুরোটা পথ হেঁটে পার করেছে। তবে যারা হাঁটতে চান না, তাদের জন্য মোটরসাইকেলের ব্যবস্থা আছে। আপ-ডাউন ভাড়া ১০০ টাকা। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে বাইকারদের দক্ষতা দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয়—এই বুঝি জীবনের শেষ ট্যুর! ঠিক তখনই বাইকার গলা ছেড়ে গান ধরবে—“ধুম ধুম…”
থাকা-খাওয়া
আমরা ছিলাম মারাইংছা ভ্যালির পড হাউজে। ভাড়া প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা। এখানে পড হাউজ ছাড়াও প্রিমিয়াম জুমঘর, কাপল জুমঘর ও তাবুর ব্যবস্থা আছে। সবগুলোর ভাড়া আলাদা। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে পড হাউজটাই সবচেয়ে ভালো লেগেছে। এটাচ বাথরুম, কমোড, সার্বক্ষণিক পানি সবই আছে।
খাবার সব রিসোর্টেই প্যাকেজ আকারে পাওয়া যায়। প্রতিদিন চার বেলা খাবারের জন্য জনপ্রতি ৮০০ টাকা। খাবারের মান খারাপ নয়, তবে দামটা আমার কাছে একটু বেশি মনে হয়েছে। প্রিমিয়াম জুমঘরের একটি বিশেষ আকর্ষণ, বাথরুমের এক পাশ পুরো কাচের।

আশপাশে কী দেখবেন
মিরিঞ্জা ছাড়াও আশপাশে আছে ঝর্ণা (এই সিজনে যাইনি), মাতামহুরী নদী (নৌকা ভ্রমণ ৭০০ টাকা), সুখিয়া ভ্যালি। সময় হাতে থাকলে আলীকদমের আলীর গুহাও ঘোরা যায়। বাচ্চা সঙ্গে থাকায় আমরা সে পথে যাইনি। চাইলে পরদিন কক্সবাজার থেকেও ঢু মেরে আসা যায়।
সব মিলিয়ে জায়গাটা একদিনেই ঘোরা সম্ভব। তবে রিল্যাক্সড ট্যুর চাইলে আরও একদিন থেকে মেঘের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেওয়া যায়। এখানে তেমন কোনো অ্যাক্টিভিটি নেই। বারবিকিউ, জোরে গানবাজনা সবই আছে। তবে আমরা সারারাত তারা আর নিস্তব্ধতা উপভোগ করেছি। দূরের পাহাড়চূড়ায় তরুণদের হাসি-আনন্দের শব্দ শুনে মনে হয়েছে বয়সটা সত্যিই বেড়েছে। তবু ওদের আনন্দ দেখতে ভালো লেগেছে।
এই ভ্রমণে আমার ৩ বছরের মেয়েসহ তিনজনই দারুণ উপভোগ করেছি। আমি প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। আমার ভালো লাগার স্কেলে অনেক কিছুই পাস করে যায়।
আমার মতে ভ্রমণের আনন্দ নির্ভর করে সাথের সঙ্গী আর আবহাওয়ার ওপর। সৌমিক ও মাহরিন ছিল একেবারে পারফেক্ট ভ্রমণ সঙ্গী। আমরা প্রায় তিন মাস আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছি, শুধু সঠিক আবহাওয়া ধরার জন্য।
শেষে বাচ্চা আছে এমন দম্পতিদের জন্য একটাই অনুরোধ, বাচ্চা নিয়ে বেশি বেশি ঘুরুন। মাটি, পানি, বাতাস, সাগর, পাহাড় দেখিয়ে বড় করুন। বিশ্বাস করুন, বাচ্চারা প্রকৃতিকে আমাদের চেয়েও ভালো বোঝে। এই পর্যন্তই মিরিঞ্জা ভ্যালির গল্প। আবার কথা হবে, অন্য কোনো পথে।
আরকে
