বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ নতুন নয়, এ যেন নিত্যদিনের ঘটনা। কেউ ইচ্ছায় আবার কেউ অনিচ্ছায় প্রতিনিয়তই দূষিত করে যাচ্ছে এ নদীর পানি। নদী বাঁচাতে ও পানি দূষণ বন্ধ করতে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।

নদীর পানিতে কেমিক্যালযুক্ত ও নগরের দূষিত পানি পড়ছে নিয়মিত। সেই সঙ্গে শহরের ও নদীর আশেপাশের এলাকার বর্জ্য তো রয়েছেই। সবমিলিয়ে নদীর পানির এখন বেহাল দশা। আর এ পরিস্থিতির জন্য সিটি করপোরেশনকে দায়ী করেছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, বুড়িগঙ্গা দূষণের দায় কোনভাবেই সিটি করপোরেশন এড়াতে পারে না। তবে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা বলছেন, আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের সচেতন হতে হবে।

রোববার (৯ মে) রাজধানীর বসিলা ও কামরাঙ্গীরচর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে থাকা সুয়ারেজ সংযোগগুলো দিয়ে অনবরত কেমিক্যালযুক্ত ও দূষিত পানি এসে নদীতে পড়ছে। নদীর পাড়েই রয়েছে অনেক ময়লার ভাগাড়। আবার কেউ আয়োজন করেই তৈরি করছে ময়লার স্তুপ।

এই স্তুপগুলোই আবার রাতের আধারে পুড়িয়ে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর কারণে দূষিত হতে হতে বুড়িগঙ্গার পানির রং এখন কালচে থেকেও কালচে হয়েছে, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। বিআইডব্লিউটিএর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গায় ৬৮টি সুয়ারেজ সংযোগ রয়েছে।

কামরাঙ্গীরচরের ঝাউচর ঘাটের মাঝি মোহাম্মাদ আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৫/১৬ বছর যাবত বুড়িগঙ্গার পানি এরকম নোংরা দেখছি। ঢাকা শহরের পানি আর মিল ফ্যাক্টরির জন্যই এমন অবস্থা। এই নোংরা পানি নিয়ে কখনও কাউকে কাজ করতে দেখিনি। পানি সব সময় এমন নোংরাই থাকে।'

শ্রমিক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, পাঁচ বছর হলো কামরাঙ্গীরচর এলাকায় কাজ করছি। এখানে আসার পর থেকেই দেখছি সবাই নদীর পাড়ে ময়লা ফেলে। সিটি করপোরেশন যে ময়লা ফেলার জায়গা দিছে সেখানে কেউ ময়লা ফেলে না। এলাকাবাসীই এখানে ময়লা ফেলে। এখান থেকে ময়লা কেউ নেয় না। সব পানিতে মিশে যায়, পানি দূষিত হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৫ নম্বর ওয়ার্ড (কামরাঙ্গীরচর) কাউন্সিলর নুরে আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পানি দূষণ রোধে আমরা চেষ্টা করছি। মাইকিং করি, জায়গায় জায়গায় আমরা সাইনবোর্ড দিয়ে লিখেও রাখি। কিন্তু আমরা নিজেরাই সচেতন না। ভেজালটা হলো এখানেই। নদীর পাশে কিছু কারখানা আছে। ওরা রাতের অন্ধকারে ময়লা ফেলে আসে পাড়ে। এমনও আছে রাতের আঁধারে নৌকা দিয়ে মাঝ নদীতে গিয়েও ময়লা ফেলে আসে। প্রশাসনও মাঝে মধ্যে ধাওয়া দেয়, তাতে কয়েকদিন বন্ধ থাকে। পরে আবার তারা ময়লা ফেলা শুরু করে।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গত বছর ডিসেম্বর মাসের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) আদর্শমান প্রতি লিটারে ৫.৫ মিলিগ্রাম থাকার কথা। কিন্তু সে পরিমাণটি একবারেই নেই। বুড়িগঙ্গার পুরান ঢাকার সোয়ারি ঘাট এলাকার পানিতে আছে ০.৪ মিলিগ্রাম, যা বুড়িগঙ্গার অন্য সব জায়গা থেকে একবারে কম। এছাড়া বসিলা ব্রিজ এলাকায় আছে ৩.২ মিলিগ্রাম, বছিলা ব্রিজ থেকে ১ কিলোমিটার উত্তরে/ওপরে আছে ২.৮ মিলিগ্রাম, বছিলা ব্রিজ থেকে ১ কিলোমিটার দক্ষিণে/নিচের দিকে আছে ২.৩ মিলিগ্রাম, ব্যাটারি ঘাটে আছে ১.৭ মিলিগ্রাম, আশরাফা বাদে আছে ১.১ মিলিগ্রাম এবং আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে আছে ০.৯ মিলিগ্রাম।

বুড়িগঙ্গা দূষণ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সিটি করপোরেশন দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হলো, নগরের যত জায়গায় ময়লা-বর্জ্য থাকবে তা নিয়ে এসে ডাম্পিং স্টেশনে রাখা। ওয়েস্ট এবং সুয়ারেজ ব্যবস্থা করাই সিটি করপোরেশনের প্রধান কাজ। প্রধান এই কাজটি করতে যদি ব্যর্থ হয় তবে এটির সম্পূর্ণভাবে দায়-দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আবর্জনা যেই ফেলুক না কেন, এটি কালেক্ট করা প্রতিষ্ঠানটিরই দায়িত্ব। মানুষ ট্যাক্স দেয় কিন্তু এই কারণেই।

তিনি আরও বলেন, আমরা যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলবো না এটি নাগরিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই দায়িত্ব আমাদের সবার। এলাকার মানুষ নদীর পাশে ডাম্পিং সাইটটা দেখতে পাচ্ছে। যার ফলে মানুষজন ওইখানেই ময়লা ফেলে। সিটি করপোরেশন এটি যদি ডোর টু ডোর, হাউজ টু হাউজ ময়লা কালেক্ট করত তাহলে এই সমস্যা হতো না।

এদিকে বুড়িগঙ্গা দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতর কি কাজ করছে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, অফিস খুললে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবো। অফিসে আসেন।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'যেসকল সোর্স থেকে পানি দূষিত হয় সেগুলো বন্ধ করার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। সব দায়িত্ব তো আমাদের না, সিটি কর্পোরেশনেরও দায়িত্ব আছে। এগুলো তারা দেখবে। বুড়িগঙ্গা বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে। সেই নির্দেশনা মতো আমাদের মন্ত্রণালয় কাজ করছে।'

এমএইচএন/এসএম