জমিতে সেচ প্রযুক্তি ব্যবহারে একদিকে কমছে খরচ অন্যদিকে বাড়ছে উৎপাদন। কেবল আমন মৌসুমেই সম্পূরক সেচ প্রয়োগের মাধ্যমে খরা মোকাবেলা করে ১০ লাখ টন বাড়তি ধান উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।

এছাড়া বেড পদ্ধতিতে ফসল চাষে ৪২ ভাগ সেচ পানি সাশ্রয় হচ্ছে। ধানের ফলন ২০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধিসহ ১৮ থেকে ২০ ভাগ ইউরিয়া সার কম দরকার হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সমীক্ষা ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) বগুড়া এর গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ব্রি সূত্র বলছে, বর্তমানে দেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৮৫ হাজার ২০৭ দশমিক ৪ হেক্টর। আর মোট সেচকৃত জমির পরিমাণ ৭৬ লাখ ১৪ হাজার ৫৭২ হেক্টর।

ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সমীক্ষায় দেখা গেছে, মোট আবাদকরা জমির মধ্যে আমন মৌসুমে ২০ লাখ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন পর্যায়ে সেচের প্রয়োজন হয়। প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। যা সেচের মাধ্যমে পূরণ করা অনেকটা ব্যয়বহুল। এ মৌসুমে বিশেষ করে ধান রোপণের সময়টাতে ও ধানের ফুল আসা পর্যায়ে যখন খরা দেখা দেয় তখন সম্পূরক সেচ প্রয়োগ করা খুবই প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ধানের জমিতে সব সময় দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই। ধানের চারা রোপণের পর জমিতে ১০ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত ছিপছিপে পানি রাখতে হবে। যেন রোপণ করা চারায় সহজে নতুন শিকড় গজাতে পারে। এরপর কম পানি রাখলেও চলবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে ধানগাছ যেন পানির স্বল্পতায় না পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, খরা কবলিত ধানের চেয়ে সম্পূরক সেচযুক্ত ধানের ফলন হেক্টরে প্রায় এক টন বেশি হয়।

বৃষ্টির পানি পুকুরে সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচ: ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টির পানি পুকুরে সংরক্ষণ করে তার মাধ্যমে সেচ প্রয়োগ করে সফলভাবে রবি ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, রবি মৌসুমের শুরুতে পুকুরের ৮০ ভাগ পানি দ্বারা পূর্ণ থাকে। যা দিয়ে রবি ফসলে তিনটি সেচ দেওয়া সম্ভব।

অগভীর নলকূপে চেক ভাল্ব সংযোজনের মাধ্যমে সেচ সহজীকরণ: বাংলাদেশের মোট সেচ করা জমির শতকরা ৮০ ভাগে সেচ দেওয়া হয় অগভীর নলকূপের মাধ্যমে। বর্তমানে প্রায় ১৬ লাখ অগভীর নলকূপ সেচ কাজে নিয়োজিত আছে।

এই অগভীর নলকূপ সেচ কাজে প্রাইমিং অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং সময় অপচয় ও অতিরিক্ত শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এর সমাধানে ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ একটি চেক ভাল্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এই চেক ভাল্ব ব্যবহার করলে মৌসুমের শুরুতে একবার প্রাইমিং করলে সারা মৌসুমে আর এর প্রয়োজন হবে না।

গভীর নলকূপে পিভিসি পাইপের মাধ্যমে পানি বিতরণ: বাংলাদেশে সেচ করা জমির পরিমাণ আবাদি জমির শতকরা ৬০ ভাগ। সেচ করা জমির শতকরা ১৫ ভাগে ভূ-উপরিস্থ পানি ও শতকরা ৮৫ ভাগে ভূ-গর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ দেওয়া হয়।

বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৬ হাজার গভীর নলকূপ ও ১৬ লাখ অগভীর নলকূপ সেচ কাজে নিয়োজিত আছে। এ ধরনের সেচ যন্ত্রে সরবরাহ করা পানির শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ অপচয় হয় শুধু নালাতেই। আবার উচ্চতাসম্পন্ন জমিতে সাধারণ পদ্ধতিতে পানি পৌঁছানো সম্ভব হয় না।

এক্ষেত্রে ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের গভীর নলকূপে পিভিসি পাইপের মাধ্যমে পানি বিতরণ পদ্ধতি প্রযুক্তি খুবই সময় উপযোগী। পিভিসি পাইপ, ক্রস, টি, বেন্ড ও ক্যাপ ব্যবহার করে সেচ যন্ত্রের পানি বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানোর বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এ পদ্ধতিতে পানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে সেচ এলাকা বৃদ্ধি ও সেচ খরচ কমানো সম্ভব। এ প্রযুক্তিতে পানি পরিবহন অপচয় প্রায় শূন্য। সাধারণ পদ্ধতির চেয়ে শতকরা ৩১.৬ ভাগ সময় সাশ্রয় হয়।

এডব্লিউডি পদ্ধতি: বোরো মৌসুমে ধান আবাদে পানি সাশ্রয়ী আর একটি পদ্ধতির নাম অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রায়িং (পর্যায়ক্রমে ভেজানো-শুকানো) বা এডব্লিউডি। এ পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন হয় একটি ৭-১০ সেন্টিমিটার ব্যাস ও ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা ছিদ্রযুক্ত পিভিসি পাইপ বা চোঙা।

শস্য বিন্যাসের মাধ্যমে খরা মোকাবেলা: ব্রি উদ্ভাবিত উত্তরাঞ্চলে খরা মোকাবেলায় বোরো ও আউশের মধ্যবর্তী সময়ে ধান রোপণ করা হলে সেটিকে ব্রাউশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ব্রাউশ মৌসুমে ব্রি ধান৪৮ তুলনামূলকভাবে ব্রি ধান২৮ এর চেয়ে বেশি ফলন দেয়। রবি শস্য হিসেবে বারি আলু-৭ বা বারি আলু-২৫ আবাদ করা যেতে পারে।

এ প্রযুক্তির অন্যতম সুবিধা হলো বৃষ্টির পানি অধিক ব্যবহারের ফলে সেচের পানির সাশ্রয় করা সম্ভব হয়। আমন (ব্রি ধান৪৯), বোরো (ব্রি ধান২৯)-পতিত শস্যক্রমের তুলনায় এ প্রযুক্তি শতকরা ৩২ ভাগ কম সেচের পানি ব্যবহার করে ফলন পাওয়া যায়। পাশাপাশি শতকরা ৪৬ ভাগ অধিক ধান ফলন মিলে।

ব্রির প্রকাশনা ও জনসংযোগ বিভাগের প্রযুক্তি সম্পাদক ও প্রধান এম এ কাসেম প্রতিষ্ঠানটির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে জানান, বর্তমানে বোরো মৌসুমে ধান চাষে সেচের জন্য প্রতি বিঘায় খরচ হয় দুই হাজার টাকার বেশি। আর সেচ খরচ বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩১ সালে প্রতি হেক্টরে (সাড়ে তিন বিঘা) এ ১৬ হাজার ৭১২ টাকায় খরচ দাঁড়াতে পারে।

পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) বগুড়া, সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক ও সেচ বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গবেষণায় দেখেছি বেড পদ্ধতিতে ফসল চাষে ৪২ ভাগ সেচ পানি সাশ্রয় হচ্ছে। ধানের ফলন ২০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধিসহ ১৮ থেকে ২০ ভাগ ইউরিয়া সার কম লাগে।

তিনি বলেন, বর্তমানে প্রযুক্তিটি উত্তরাঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। কৃষকেরাও অনেক বেশি উপকার পাচ্ছেন। এছাড়া এর ব্যবহারও অনেক বেশি বাড়ছে।

একে/ওএফ