সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাটা হয়েছে বেশ কিছু সংখ্যক গাছ/ ছবি : সুমন শেখ

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গাছের অবদান অনস্বীকার্য। মানুষ নানাভাবে গাছের ওপর নির্ভরশীল। সময় যত গড়াচ্ছে তত বাড়ছে মানুষ, কমছে গাছপালা। এতে দেখা দিচ্ছে অক্সিজেন সংকট। বাতাস হচ্ছে ভারী। বাতাসে বাড়ছে নানা ক্ষতিকর কণা।

গাছপালা কমার চিত্র বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় রাজধানী ঢাকাতে। গত কয়েক দশকে আধুনিকতা আর উন্নয়নের হাওয়ায় বদলে গেছে এ শহর। এ শহরে সবুজ আর আগের মতো দেখা যায় না। ঢাকা ক্রমেই হয়ে উঠেছে কংক্রিটের এক নগরী। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই গত ৪০ বছরে গাছের সংখ্যা কমেছে ৪০ শতাংশ। এ গবেষণা থেকে ঢাকার বাকি অংশের চিত্র অনুমান করা যায়।

পরিবেশবিদরা বলছেন, ঢাকাতে প্রতিনিয়ত উন্নয়ন হচ্ছে। যে জায়গায় কিছুদিন আগেও গাছ ছিল, সেখানেও এখন ইমারত নির্মাণ হচ্ছে। ইমারত নির্মাণেই গাছগুলো কাটা পড়ছে। বর্তমানে ঢাকার কেন্দ্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন গাছ নেই বললেই চলে। অধিকাংশই সরকারি মালিকানাধীন গাছ।

ঢাকার আশেপাশে সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ এবং বসিলায় নদীর ওপারে প্রচুর গাছপালা ছিল। উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে সেগুলোও কাটা হচ্ছে। যে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলে, সবার আগে কোপটা বসে গাছের ওপর। গাছ রেখেও যে ইমারত করা যায়, সেটা কেউ মাথায় রাখে না। একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছ কেটে নতুন পাঁচটি গাছ লাগালেও ক্ষতি পূরণ হয় না।

 সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটার প্রতিবাদ/ ছবি : সুমন শেখ

এদিকে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে গাছ কাটা পড়ার বিষয়টি স্বীকার করছে সরকার। সরকার বলছে, প্রতি মৌসুমে নতুন করে গাছ লাগানো হচ্ছে।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২০২০ সালের আগের চল্লিশ বছরে প্রায় ৪০ ভাগ গাছ কমেছে। সর্বশেষ ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কমেছে ১৮ ভাগ, যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বাকি ৩০ বছরে কমেছে ২২ ভাগ।

এইতো কিছুদিন আগেও উন্নয়নমূলক কাজের কথা বলে রাজধানীর প্রাণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু গাছা কাটা হয়েছে। একটি মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কোপ পড়েছে শহরের প্রাচীন গাছগুলোতে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও বলছে, প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনাই গাছ রেখেই করা যায়। আর এটির জন্য সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। সরকার মুখে বড় কথা বললেও পরিকল্পনায় গাছ থাকে না। এটি থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাটা হয়েছে বেশ কিছু সংখ্যক গাছ/ ছবি : সুমন শেখ

ঢাকা শহরে সবুজের বর্তমান অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন,  আমাদের উদ্যানগুলোতে গাছ বাঁচানোর জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। বিভিন্ন সময়ে ঝড়, দূষণসহ অন্যান্য কারণে গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ক্ষতিগ্রস্ত গাছ আর নতুন করে কেউ যত্ন নেয় না, লাগায়ও না।

তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি, সরকারের এক প্রতিষ্ঠান অনেক টাকা খরচ করে গাছ লাগাচ্ছে। আবার সরকারেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সেই গাছগুলো কাটছে। গাছ কাটছে কী কারণে? উন্নয়নের জন্য। সর্বশেষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কথা আপনারা জানেন। সেখানে গাছগুলো রেখেও প্রকল্পের নকশা করা যেত। কিন্তু তা হয়নি। পৃথিবীর অনেক দেশে আমরা ঘরবাড়িসহ ইন্ডাস্ট্রি করতে দেখেছি গাছপালা রেখে। এটি আমাদের এখানে এখনও পর্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।  

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২০ সালে ৪৩৭ টন ধুলোবালি ঢাকা শহরের সব গাছের ওপর পড়েছে। সেই সংখ্যা ২০২১ সালে এ পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ টনে। ধুলোবালি জমায় গাছের সালোকসংশ্লেষণ হয় না। এতে খাদ্য তৈরি হয় না। ফলে গাছ মারা যায়।

তিনি বলেন, অনেকে বলেন ঢাকার বাতাস অনেক ভারী। এর কারণ যে পরিমাণ মানুষ আছে, সেই অনুপাতে গাছগুলো অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে না। গাছ বংশবিস্তার করে মূলত পরাগায়নের মাধ্যমে। গাছের পাতায় যখন ধুলোবালি জমে, তখন পাখি বা কীটপতঙ্গ গাছে বসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। আর এরা যদি এক গাছ থেকে আরেক গাছে না যায় তবে পরাগায়ন হয় না।

কীভাবে ঢাকার সবুজ বাড়ানো যায়- জানতে চাইলে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, ঢাকায় যে উদ্যানগুলো আছে, সেগুলোতে পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগাতে হবে। এ পরিকল্পনায় উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও মৃত্তিকাবিজ্ঞানীদের সহায়তা নেওয়া উচিত। কোন মাটিতে কোন ধরনের গাছ লাগানো যাবে, এটা তারা অনেক ভাল বলতে পারবেন। আর এতে করে গাছ টেকসই হবে।

কাটার জন্য গাছে লাল দাগ দিয়ে রাখা হয়েছে/ ছবি : সুমন শেখ

তিনি বলেন, প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। দুই মেয়র ঘোষণা দিয়েছেন, ছাদ বাগান করলে ট্যাক্স কমানো হবে। এই বিষয়টি এখনও অনেকে জানেন না। বিষয়টি সবাইকে জানাতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। সবুজায়নে বন ও কৃষি অধিদফতরকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের একটি বিষয়ে খুবই কঠোর হতে হবে যে, যেকোনো উন্নয়ন আমরা সমর্থন করি, তবে সেখানে গাছ কেটে ফেলা হবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ঢাকা শহরে গাছের পরিমাণ বাড়াতে হবে। জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সেই হিসাবে আমাদের শহরে পার্ক বা গাছের সংখ্যা বাড়ছে না। সুতরাং বর্তমানে যে পার্ক এবং গাছগুলো আছে, সেগুলো যেন থাকে এবং এখানে যেন পরিমাণটা আরও বাড়ানো যায় সে বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে। অন্যথায় আমরা কেউ টিকে থাকতে পারব না। গাছপালা না থাকলে মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীসহ পরিবেশ ভালো থাকে না।

তিনি আরও বলেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ খুন করা এবং তিন সন্তান জন্ম দেওয়া যেমন একই বিষয় হতে পারে না। তেমনি একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছ কেটে নতুন পাঁচটি গাছ লাগালে এক সমান হয় না। কারণ, একটি গাছ পরিপূর্ণ হতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগে। সেটা ৩০ থেকে ৫০ বছরও হতে পারে। সরকারের শুধু গাছ লাগালে হবে না, গাছগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি নতুন গাছ লাগাতে হবে।

রাজধানীতে সবুজ বাড়ানোর বিষয়ে সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যেক সিজনে (মৌসুমে) গাছ লাগানো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গাছ লাগাচ্ছে। উন্নয়নমূলক কাজে কিছু গাছ কাটা পড়েছে, এ বিষয়টি সত্যি। তবে নতুন করে গাছ লাগানো হচ্ছে। সারাদেশে এ বছর সাত কোটির বেশি গাছ লাগানো হবে।

এমএইচএন/আরএইচ