‘প্রিয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ, আপনাদের মধ্যে কেউ চিকিৎসক থাকলে নিকটবর্তী কেবিন ক্রু’র সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমি আবারও বলছি, আপনাদের মধ্যে যদি কোনো চিকিৎসক থাকেন তাহলে দ্রুত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’

মাস্কাট থেকে ঢাকাগামী বিজি-০২২ ফ্লাইটটি ছাড়ার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর একজন কেবিন ক্রু দুই বার একই বাক্য উচ্চারণ করলেন। এরপর কেবিন ক্রুরা প্লেনের করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রতি সারির যাত্রীদের জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘আপনাদের মধ্যে কোনো চিকিৎসক আছেন কি? কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা করতে পারেন কি?’

এভাবেই ঢাকা পোস্টকে সেই ফ্লাইটের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন ওমানপ্রবাসী বাংলাদেশি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার আরিফুল ইসলাম। তিনি সেই ফ্লাইটে বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করছিলেন। ককপিটের খুব কাছাকাছি থেকে বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ করেছেন আরিফুল।

ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, যখন কেবিন ক্রুরা চিকিৎসকের খোঁজ করছিলেন তখনই বুঝতে পেরেছিলাম ফ্লাইটে কেউ অসুস্থ হয়েছে। তবে ক্যাপ্টেন যে নিজেই হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন, সেটি বুঝতে পারিনি। পাইলট বা কেবিন ক্রুরাও তা বুঝতে দেয়নি।

পুরো ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা নিয়ে আরিফুল বলেন, ফ্লাইটটি বৃহস্পতিবার মধ্যরাত ২টা ৩০ মিনিটে (ওমানের স্থানীয় সময়) ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল। পরে এটি ডিলে (সময় পরিবর্তন) হয়ে সাড়ে ৪টায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়। আমরা সাড়ে ৪টায় বিমানে উঠে যাই। তবে প্লেন ছাড়েনি। আমাদের প্লেনের ভেতরে রেখে বলা হলো, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ফ্লাইট আরও ২ ঘণ্টা বিলম্বে রওনা হবে।

‘এরপর সাড়ে ৬টার দিকে প্লেন ছাড়ে। প্রায় তিন ঘণ্টা ফ্লাইটটি আকাশে উড়ে। আকাশটা স্বচ্ছ ছিল। প্লেনটাও স্বাভাবিকভাবেই উড়ছিল। হঠাৎ ককপিট থেকে জানতে চাওয়া হয়, আমাদের মধ্যে কোনো ডাক্তার আছে কি না? কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা করতে পারি কি না, কারও নার্সিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে কি না ইত্যাদি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, আমাদের মধ্যে কোনো যাত্রী হয়ত অসুস্থ।’

প্লেনের সামনের সারিতে বিজনেস ক্লাসের একটি নম্বর সিটে ছিলেন আরিফুল। ওই ক্লাসে তিনি ছাড়া আরেকজন নারী যাত্রী ছিলেন। বাকি সিটগুলো খালি ছিল। সেখানে বসেই হঠাৎ শুনলেন কেবিন ক্রুর ঘোষণা, ফ্লাইটটি ভারতের নাগপুর বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করবে।

আরিফুল বলেন, এ ঘোষণা শুনে আমরা পেছনে ও আশপাশে দেখি, তবে কোনো রোগী দেখতে পাইনি। কেবিন ক্রুর ঘোষণার ১৫-২০ মিনিটের মাথায় ফ্লাইটটি অবতরণ করে। অবতরণের পর যখন প্লেনটি থামল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটি অ্যাম্বুলেন্স প্লেনের দরজার সামনে চলে আসে। হঠাৎ দেখি পাইলট স্যারকে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে কয়েকজন তুলে নিয়ে গেছে। একজন কেবিন ক্রু অক্সিজেন সিলিন্ডার ধরে ছিল। মুহূর্তেই তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ফ্লাইটের ফার্স্ট অফিসার ও কেবিন ক্রু’রা অত্যন্ত দক্ষ ও পেশাদার ছিল। তাদের কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখালেও তারা কখনও আমাদের পাইলটের অসুস্থতার বিষয়টি বুঝতে দেননি। বুঝলে হয়ত আকাশেই অনেকে ভয় পেত।

পাইলটকে নিয়ে যাওয়ার পরের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, পাইলটকে নিয়ে যাওয়ার পর ভারতের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন ফ্লাইটে ঢুকে আমাদের তল্লাশি করে। প্লেনের বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালায়। এরপর আমাদের প্লেন থেকে নেমে বিমানবন্দরে যেতে বলে। তবে যাত্রীরা বিমানবন্দরে যেতে রাজি হচ্ছিল না। কেউ কেউ নেমে গেলেও অনেকেই জেদ করে বসে ছিলেন। পরে অবশ্য তারাও নামেন। রাতে আমাদের নতুন বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়।

সেদিন যা ঘটেছিল

শুক্রবার (২৭ আগস্ট) সকালে ওমানের মাস্কাট থেকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে বিজি-০২২ ফ্লাইটটি নিয়ে ঢাকা আসার পথে ভারতের আকাশে থাকা অবস্থায় ক্যাপ্টেন নওশাদ অসুস্থ বোধ করেন। পরে ফ্লাইটটিকে মহারাষ্ট্রের নাগপুরের ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করানো হয়।

আকাশে অসুস্থ হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাপ্টেন নওশাদ ফ্লাইটটিকে কলকাতার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (এটিসি) কাছে জরুরি অবতরণের অনুরোধ জানান। একই সময় তিনি কো-পাইলটের কাছে ফ্লাইটের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন।

কলকাতার এয়ার ট্রাাফিক কন্ট্রোল ফ্লাইটটিকে নিকটস্থ নাগপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করার নির্দেশ দিলে ফার্স্ট অফিসার মুস্তাকিম ফ্লাইটটি অবতরণ করান।

বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের ওই ফ্লাইটে ১২৪ জন যাত্রী ছিলেন। তারা সবাই নিরাপদে ছিলেন। শুক্রবারই আরেকটি ফ্লাইটে করে আট সদস্যের একটি উদ্ধারকারী দল নাগপুরে যায়। মধ্যরাতের পর বিমানটিকে যাত্রীসহ ঢাকার বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়। 

বর্তমানে পাইলটের শারীরিক অবস্থা

সর্বশেষ শনিবার রাতের আপডেট অনুযায়ী, ভারতের নাগপুরের কিংসওয়ে হাসপাতালের সার্জিকেল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এসআইসিইউ) কোমায় আছেন। হাসপাতালের মেডিকেল সার্ভিসেস ডিরেক্টর ডা. সুভরজিৎ দাশগুপ্ত, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ফিজিশিয়ান ডা. রঞ্জন বারোকার, এবং ডা. বীরেন্দ্র বেলেকারের অধীনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।

ভারতের নাগপুরের কিংসওয়ে হাসপাতালের হাসপাতালের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) রোশান ফুলবান্ধে জানান, প্রথমে ক্যাপ্টেন নওশাদের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। ক্যাপ্টেন নওশাদের হার্টের এনজিওগ্রাম করা হলে দুটি রক্তনালীতে ব্লক পাওয়া যায়। তবে মাত্র ৬০-৭০ ভাগ। এটি প্রায় স্বাভাবিক। এরপর তার মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তিনি আনরেসপনসিভ এবং আনকনশাস (কোন সাড়া দিচ্ছেন না, সম্পূর্ণ অচেতন) অবস্থায় আছেন। শনিবার দুপুরে তাকে প্রায় আধঘণ্টা সিপিআর (বুকে চাপ দেওয়াসহ নানা কৌশলে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা) দেওয়া হয়েছে। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রটোকল অনুযায়ী এ ধরনের রোগীকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। তাকে এসআইসিইউতে পাঠিয়ে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে।

১৪৯ যাত্রীর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন নওশাদ

নওশাদ ও তার ফার্স্ট অফিসারের কারণে এবার জীবন রক্ষা পেয়েছে ওমান থেকে ঢাকার উদ্দেশে আসা ১২৪ যাত্রীর। তবে এটি প্রথম নয়। পাঁচ বছর আগে এভাবেই আরও ১৪৯ যাত্রী আর সাত ক্রুর জীবন বাঁচিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন নওশাদ। পেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি-১২২ ফ্লাইটে ক্যাপ্টেন ছিলেন নওশাদ। সেই ফ্লাইটটি মাস্কাট বিমানবন্দর থেকে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। টেক-অফ করার পর মাস্কাট বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ক্যাপ্টেনকে জানানো হয়, রানওয়েতে টায়ারের কিছু অংশ পাওয়া গেছে, যা সম্ভবত বিমান এয়ার ক্রাফটের হতে পারে।

সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় এবং যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নওশাদ ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। অবতরণের আগে ক্যাপ্টেন ফ্লাইটটি নিয়ে রানওয়ের ওপর দিয়ে ‍দুইবার লো-লেভেলে ফ্লাই করেন। তখন দেখা যায়, উড়োজাহাজের পেছনের দুই নম্বর টায়ারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে ক্যাপ্টেন নওশাদ উঁচু মানের দক্ষতার সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত টায়ার ও ল্যান্ডিং গিয়ারসহই নিরাপদে ফ্লাইটটি ঢাকায় অবতরণ করাতে সক্ষম হন।

এ ঘটনার পর ২০১৭ সালে ক্যাপ্টেন নওশাদকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রশংসাপত্র পাঠায় আন্তর্জাতিক পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ক্যাপ্টেন রন অ্যাবেল।

ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইউম ২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে পাইলট হিসেবে যোগদান করেন।

এআর/এসএসএইচ