দীর্ঘ ৩২ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টানছেন ১৮১ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজের ৭৪তম অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার। ১৯৮৯ সালে ৮ম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) কর্মকর্তা হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় নাম লেখান তিনি। ৩২ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ২০ বছরই কাটিয়েছেন ঢাকা কলেজে। টানা সাত বছর কলেজের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা কলেজের সাথে রয়েছে তার আত্মার সম্পর্ক। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রভাষক হিসেবে যুক্ত হয়ে ইতি টানলেন অধ্যক্ষ হিসেবে। দীর্ঘ এই পথচলার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, প্রতিবন্ধকতা, শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা ও অবসর পরবর্তী জীবন নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সাথে। সেই বিশেষ সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন রাকিবুল হাসান তামিম।

ঢাকা পোস্ট : শেষ কর্মদিবসের অনুভূতি কী?
অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার : শিক্ষা ক্যাডারে আমি দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে চাকরি করেছি। যদিও আমার চাকরি জীবন হয়েছিল ব্যাংকিং খাতে ১৯৮৭ সালে। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে অষ্টম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে শিক্ষকতা শুরু করি এবং আজ অবধি এই দীর্ঘ সময় জুড়ে শিক্ষার্থীদের সাথেই আমার সময় কেটেছে।

শিক্ষা ক্যাডারে আমাদের অফিসিয়াল চাকরির সুযোগ রয়েছে, তবে আমি তাতে আগ্রহী ছিলাম না। আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকাই আনন্দের বিষয়। 

আমি ৪ বছর সরকারি কবি নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ এবং এক বছরেরও বেশি সময় ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করলাম। এছাড়া দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি- এখনও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে।  

ঢাকা পোস্ট : আজ আপনি দীর্ঘ ৩২ বছরের চাকরি জীবন শেষ করলেন। কোনো অপ্রাপ্তি রয়েছে?
অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার : আমি সবসময়ই বলি আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। ঢাকা কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছি, এটা আমার জন্য অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের। আমি অনেক পেয়েছি তবে সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক কিছুই করতে পারিনি।  মূলত করোনাকালে আমি দায়িত্ব পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর সাধ্য মতো চেষ্টা করেছি সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। আমার অপ্রাপ্তি নেই, তবে সীমাবদ্ধতা ছিল।

ঢাকা পোস্ট : বর্তমান সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন?
অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার : আমি মনে করি দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের এখনও ক্লাসমুখি করতে পারিনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ক্লাসে নিয়মিত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীদের না থাকার ফলে আমরা শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা সব সময়ে সমান্তরালভাবে ধরে রাখতে পারছি না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। ইচ্ছা মতো যতো খুশি ততো শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর ফলেই এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন। না হয় জাতি হিসেবে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। তবে আমি স্বাভাবিকভাবে বলবো বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা এগিয়ে যাচ্ছে। তবু সামনের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মানসম্মত, টেকসই ও  হাতে কলমে শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। 

ঢাকা পোস্ট : আপনি দীর্ঘদিন শিক্ষা ক্যাডারের নেতৃত্ব দিয়েছেন সে জায়গা থেকে কী বলবেন?
অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার : শিক্ষা ক্যাডারে অনেক অপ্রাপ্তি এবং হতাশা রয়েছে। এটা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ক্যাডার হলেও সুযোগ-সুবিধা ও বেতনের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ে সমতা আনয়নের জন্য নির্দেশনা দিলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো অগ্রগতি বা তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। যার ফলে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা অসম্মানজনকভাবে অবসরে যাচ্ছেন। তাদের সমমানের যোগ্যতাসম্পন্ন অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছেন। তাই আমার চাকরির শেষ সময়েও আমি বলবো যে প্রধানমন্ত্রীর যে নির্দেশনা ছিল সেটা দ্রুত যেন বাস্তবায়ন করা হয়। এতে যদি বিলম্ব হয় তবে ভবিষ্যতে মেধাবীরা শিক্ষা ক্যাডারে  আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আর মেধাবীরা যদি শিক্ষা ক্যাডারের না আসে, তবে ভবিষ্যত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। 

ঢাকাপোস্ট : আপনি ছাত্রজীবনে যে স্বপ্ন দেখতেন সেটা পূরণ হয়েছে?
অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার : বিষয়টা সময়ের প্রেক্ষাপটে মেলানো যাবে না। আমি বিজ্ঞান পড়তে চেয়েছিলাম। গ্রামের হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছি। সেখানে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় বাধ্য হয়েই আমাকে কমার্সে ভর্তি হতে হয়েছে। সেখানেই কিন্তু আমার গতিপথ একবার পরিবর্তন হয়েছে। আমি পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছি, অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছি, উচ্চ মাধ্যমিকে বোর্ডে ১২তম স্থান অর্জন করেছি। তাই কমার্সেই যেহেতু পড়ি তখন চিন্তা করেছিলাম চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হবো। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন এরশাদের শাসনামলে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত সময় লেগে যায়। চার বছরের কোর্স শেষ করতেই সময় লেগেছে সাড়ে সাত বছর। যার ফলে পরবর্তীতে সিএ পড়ার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়ে দিই। তবে আমার অতৃপ্তি নেই। শিক্ষকতায় আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সামাজিক মান মর্যাদা সবকিছুতেই ভালো লাগা কাজ করে। আসলে ঢাকা কলেজ তো সারা দেশে একটি মাত্রই প্রতিষ্ঠান। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবেই আমি অত্যন্ত গর্ববোধ করি।

ঢাকা পোস্ট : অবসর কিভাবে কাটানোর চিন্তা করছেন?
অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার : সত্যিকার অর্থে যদি বলি ২৪ তারিখ পর্যন্ত আমি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। আমি এখন পর্যন্ত অবসরে কী করবো তা চিন্তাও করিনি। ভবিষ্যতে কী করব এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। তবে আমি বেশ কিছু সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে জড়িত রয়েছি। বিশেষ করে স্কাউটিংয়ে আমি জাতীয় কমিশনার (এক্সটেনশন স্কাউটিং) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়াও আমাদের একটি স্কুল রয়েছে, সমিতির হাউজিং প্রকল্প রয়েছে। আমার সুযোগ রয়েছে এসব জায়গায় কাজ করার। আর আমার ইচ্ছা হচ্ছে দেশ-বিদেশে ঘুরব।

ঢাকা পোস্ট : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার : তোমাকেও  ধন্যবাদ। তোমরাও ভালো। আশীর্বাদ রইল। 

আরএইচটি/এনএফ