শিক্ষার্থী না হয়েও ‘ভুয়া’ পরিচয়ে সাড়ে তিন বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছেন সাজিদুল কবির। বিভাগের ১৩তম ব্যাচের ক্লাস-পরীক্ষা এমনকি আচার-অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন বৈধ শিক্ষার্থীর মতো। সর্বশেষ বুধবার ষষ্ঠ সেমিস্টারের একটি কোর্সের পরীক্ষা চলাকালে ধরা পড়েন তিনি।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি ওই বিভাগের শিক্ষার্থী নন। পরে স্বীকারোক্তি দিলে অধিকতর তদন্তের জন্য তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়।

এখন প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও কীভাবে ওই তরুণ সাড়ে তিন বছর বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে আসছিলেন? কীভাবেই বা শনাক্ত হলেন? বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্ট।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সূত্রে জানা যায়, বিভাগ ছেড়ে চলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ডাটা কালেক্ট করে তাদের রোল নম্বর অনুযায়ী ক্লাস ও ইনকোর্স পরীক্ষায় অংশ নিতেন সাজিদুল। সর্বশেষ পঞ্চম সেমিস্টারের ৫০১ নম্বর কোর্স 'সেশনাল নম্বর' পেয়েছেন এমন একজন শিক্ষার্থী, যিনি কিনা প্রথম সেমিস্টারেই বিভাগ ছেড়ে চলে গেছেন। এ ঘটনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে। একই সেমিস্টারের ৬০৪ নম্বর কোর্সের ক্লাস টেস্টের পর রোল অনুযায়ী খাতা সাজানোর সময় ইমরুল হাসানের খাতা পাওয়া যায়। তখন সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। বিষয়টি শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট কোর্সের (কোর্স নং- ৬০৪) শিক্ষক অধ্যাপক ড. এস এম আলী রেজাকে অবহিত করেন।

পরে বুধবার (২৪ আগস্ট) উক্ত সেমিস্টারের একটি ক্লাস টেস্ট চলাকালীন সন্দেহজনক পরিস্থিতি তৈরি হলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষককে জানান। পরে সাজিদুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিভাগীয় কার্যালয়ে রক্ষিত নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও কথিত সাজিদুলের দেওয়া তথ্যের মধ্যে কোনো মিল না থাকায় বিভাগের পক্ষ থেকে তাকে প্রক্টর অফিসে হস্তান্তর করা হয়। বুধবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম বরাবর সা‌জিদুল মুচলেকা দেন। সেখানে স্বীকার ক‌রেন, তিনি ২০১৮ সা‌লের ভ‌র্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন এবং ২০১৯ থে‌কে লু‌কি‌য়ে ক্লাস ক‌রছেন। এরপর বিস্তারিত জানতে এবং ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়।

ঢাবি কেন্দ্রিকবিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে নিজেদের বিস্ময়, কৌতূহল ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ বলছেন, এত লম্বা সময় ধরে জালিয়াতি করে পার পাওয়ার পেছনে বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলা দায়ী। তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়  প্রশাসন শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর রাখে না।

বিভাগের শিক্ষকরা বলছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রত্যেক ব্যাচে ২০০-২২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এত শিক্ষার্থীর মধ্যে সবাইকে চেনা সহজ নয়। এছাড়া সাজিদুল ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতেন না। কারণ ফাইনালে অংশ নিলে যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ থাকে, যেটা অন্য পরীক্ষায় থাকে না।

বিভাগের (২০১৮-১৯শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থীরা এতদিন সাজিদুলকে তাদের সহপাঠী ভেবে এসেছেন। তারা জানান, সাজিদুল তাদের সঙ্গে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করত। যেমন- একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে শ্যাডোতে এক্সামের কোর্স ম্যাটারিয়াল নেওয়া, সূর্যসেনের ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে যাওয়া, সমাজবিজ্ঞান চত্বরে আড্ডা দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ব্যবহার করা, ব্যাচডে-তে অংশ নেওয়া ইত্যাদি। তাই সাজিদুলকে অছাত্র বলে ভাবা যেত না।

সাজিদুলকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় উপস্থিত ছিলেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মামুন আল মোস্তফা। তিনি জানান, ২৪ আগস্ট দুপুর পৌনে ১২টায় উক্ত সেমিস্টারের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান,  ক্লাস টেস্ট দিতে আসা একজনকে অছাত্র হিসেবে সন্দেহ করছেন তারা। আমি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী, অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ও সহযোগী অধ্যাপক জনাব মো. মনিরুল ইসলামকে বিষয়টি অবহিত করি। তারপর ড. মজুমদার ও জনাব ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে আমি পরীক্ষার হলে যাই। সাজিদুল কবীর তার রোল নম্বর  ২৫২ বলে পরিচয় দেয়। বিভাগীয় নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও  সাজিদুলের দেওয়া তথ্যের মধ্যে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। পরে বিভাগের পক্ষ থেকে প্রক্টরের কার্যালয় ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের কাছে  সাজিদুলকে হস্তান্তর করা হয়।

এতদিন পর কেন বিষয়টা সামনে আসল জানতে চাইলে বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, তিনি আমার ক্লাসেও অংশ নিয়েছেন। বিভাগের এত বেশি শিক্ষার্থী যে সবার মুখ চেনা কিংবা সবসময় আইডি কার্ড দেখা সম্ভব নয়। ফাইনাল পরীক্ষায় সবকিছু যাচাই-বাছাই করা হয়, কিন্তু এটাতে তিনি অংশ নেননি।

সাজিদুলকে শনাক্ত করতে মুখ্য ভূমিকা রাখা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সন্দেহ হয় কেউ একজন আছে যে অন্যের না‌মে পরীক্ষা দিচ্ছেন। গত ২১ আগস্ট ষষ্ঠ সেমিস্টারের এক‌টি কো‌র্সের ক্লাস‌ টেস্ট শে‌ষে আমরা উত্তরপত্রগু‌লো গু‌ছি‌য়ে দি‌চ্ছিলাম স্যার‌কে। তখন আমা‌দের চোখে প‌ড়ে মে‌ডিকেলে চ‌লে যাওয়া একজন ছাত্রের রোল ও নামসম্বলিত খাতা‌টি। তারপর আমরা এটেন‌ডেন্স শিট দে‌খে তার আশপাশে কে ব‌সে‌ছিল তা বের ক‌রি। তার সামনে বসা বন্ধু‌টি জানায়, তার নাম সাজিদুল। এরপর আমরা তা‌কে হা‌তে-না‌তে ধরার অপেক্ষা ক‌রি। এরপর ২৪ আগস্ট এক‌টি কো‌র্সের ক্লাস‌ টেস্ট পরীক্ষা শুরুর আগেই মামুন আলমোস্তফা স্যার‌কে বিষয়টি অব‌হিত ক‌রি।

 তিনি আরো বলেন, সাজিদুল ব্যাচমেটদের বলতেন তিনি খুব দ্রুতই দেশের বাইরে চলে যাবেন, তাই পরীক্ষায় বসছেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধারণত ফাইনাল পরীক্ষা ছাড়া কারো আইডি কার্ড চেক করা হয় না। আর এত শিক্ষার্থীর মাঝে সবাইকে চেনাও কঠিন। এই শিক্ষার্থী (সাজিদুল) কোনো মার্কশিটও পাননি। যেসব ক্লাস টেস্ট-ইনকোর্সপরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, সেগুলোও অন্যদের নামে ফলাফল এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযুক্ত তরুণ স্বীকার করেছেন এবং লিখিত দিয়েছেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন। তদন্তের স্বার্থে তাকে শাহবাগ থানায়সোপর্দ করা হয়েছে।

শাহবাগ থানারভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার বলেন, তিনি জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন তার অনেক স্বপ্ন ছিল ঢাবিতে পড়ার। কিন্তু তিনি স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায়, তিনি  আর কোথাও ভর্তি হননি। ঢাবিতেই ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতেন এবং ঢাবির ছাত্র পরিচয় দিয়ে টিউশনি করতেন। আমরা তার আর কোনো খারাপ উদ্দেশ্য পাইনি। তাকে তার মা-বাবার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এইচআর/এমএইচএস