বেরোবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে আত্মীয়করণের অভিযোগ উঠেছে। নিজের মা, ভায়রা, ভাগনেসহ এলাকার আত্মীয়দের অনেককেই তিনি চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা করে দিয়েছেন।

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় নিজেকে ‌একাই একশ প্রমাণ করতে দখলে নিয়েছিলেন ট্রেজারার, বিভাগীয় প্রধান, ডিন, পরিচালকসহ বিভিন্ন কমিটির সভাপতি পদ-পদবী। তার স্বেচ্ছাচারিতা, অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম, দুর্নীতি আর ক্যাম্পাসে দীর্ঘ অনুপস্থিতি বিষিয়ে তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে ওঠা এমন অসংখ্য অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ মিলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সময়ের নিয়োগ বোর্ড, নথিপত্র আর উপাচার্যের কাণ্ড নিয়ে এখন ক্যাম্পাসের ভেতরে-বাইরে সবখানেই আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ যখন যা ইচ্ছে হয়েছে, তাই করেছেন। আর এতে সায় দিয়েছেন তার কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির তালিকায় থাকা শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকেই। 

সর্বশেষ বেরোবির শেখ হাসিনা হল এবং ড. ওয়াজেদ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নির্মাণে তার বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত নকশা পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর অভিযোগে তার ভাগনে ইঞ্জিনিয়ার মজনুর কাদের এবং অন্যান্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে ইউজিসির তদন্ত কমিটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় ট্রেজারার, ছয়টি ডিপার্টমেন্টের প্রধান, ছয়টি অনুষদের মধ্যে পাঁচটির ডিন, সাত বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির সভাপতি এবং ই-লার্নিং সেন্টার, সাইবার সেন্টারের পরিচালকের পদ একাই দখল করে রেখেছিলেন উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। পরে সমালোচনার মুখে তিনটি ডিপার্টমেন্ট ও চারটি ডিনের পদ ছেড়ে দেন। সম্প্রতি ট্রেজারার পদে একজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। নিজের মা নিলুফার বেগমকে বানিয়েছেন নিয়োগ বোর্ডের সদস্য। যা নিয়ে এখনও বিতর্ক চলমান।

বর্তমানে উপাচার্য ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের পরিচালক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ বেশ কিছু পদে রয়েছেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলের দায়িত্বে উপচার্য তার ব্যক্তিগত সচিব আমিনুর রহমানকে রেখে কার্যত পরিবহন পুল নিজের কব্জায় রেখেছেন। 

উপাচার্যের বিরুদ্ধে সমাজবিজ্ঞান এবং জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক নিয়োগেও আছে আত্মীয়করণের অভিযোগ। এই পদের নিয়োগ বোর্ডে উপাচার্য পদাধিকার বলে, বিভাগের সভাপতি হিসেবে এবং ডিন হিসেবে তিনটি পদে একাই প্রতিনিধিত্ব করেন ড. কলিমউল্লাহ। সেখানে এক্সপার্ট হিসেবে তার মা নিলুফার বেগমকে করেছেন নিয়োগ বোর্ডের সদস্য। এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর নামে।

এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপাচার্য যা করেছেন সবই হাস্যকর বিষয়। ওই বোর্ডের বিভাগীয় সভাপতি ও ডিন উপচার্যের মা। এ ছাড়াও আবুল কাশেম নামে একজন শিক্ষক আছেন, যিনি উপাচার্যের আস্থাভাজন। তাকে ১২টি নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করা হয়েছে। এভাবে অনেক জায়গাতে দুর্নীতি করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (নীল দল) সাধারণ সম্পাদক আসাদ মণ্ডল অভিযোগ করেন, উপাচার্যের তার পিএসের ভায়রাকেও একটি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নিয়েছেন। ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টরকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। তার ৩৮ বছর বয়সকে আড়াল করে ৩০ দেখিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন।  
 
অভিযোগ রয়েছে, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে উপাচার্য তার নিজ এলাকা কুমিল্লার চান্দিনার আবু হেনা মুস্তাফা কামালকে রেজিস্ট্রার পদে ও ভর্তি জালিয়াতির দায়ে পাঁচ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আবুল কালাম আজাদকে নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়াও নিয়োগ বাণিজ্যে অভিযুক্ত আমিনুর রহমানকে ব্যক্তিগত সচিব পদে নিয়োগ ও আইন ভেঙে পদোন্নতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, উপাচার্য তার স্ত্রীর বোনের স্বামী মাহমুদুল হাসানকে গোপনে নিয়োগ দিয়ে আত্মীয়করণের নজির সৃষ্টি করেছেন।

বেরোবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি গাজী মাজহারুল আনোয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাননীয় উপাচার্যকে আমাদের মহামান্য আচার্য নিয়োগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে। এটার জন্য একটা আইনও আছে। সেই আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। কিন্তু এই উপাচার্য আসার পর সেই আইনকে পদদলিত করে নিজের ইচ্ছামতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছেন। শুরুতেই উনি (উপাচার্য) একজন পিএ নিয়োগ দিয়েছেন। সেই ব্যক্তি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে অনিয়ম করার দায়ে অভিযুক্ত এবং শাস্তিপ্রাপ্ত। 

বেরোবির অধিকার সুরক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক শিক্ষক মতিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সব জায়গাতেই সমস্যা রয়েছে। এখানে নিয়োগের ক্ষেত্রে আত্মীয়করণ এবং একটি অঞ্চলকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কিছু জেলার লোকজন সেখানে বেশি সুবিধা পেয়েছেন। যা কিছু হয়েছে সবই উপাচার্য তার ইচ্ছাতেই করেছেন। এসব করতে কখনও আইন ও নিয়ম-নীতির কথা ভাবেননি।    

এদিকে এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। উপাচার্য ইদানিং ক্যাম্পাসে আসছেন না বলে জানান তার বাংলোর একজন কেয়ারটেকার।

উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ রাষ্ট্রপতির নির্দেশ অমান্য করে ক্যাম্পাসে ধারাবাহিক অনুপস্থিত থেকে রেকর্ড গড়েছেন। উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর ১৩৫৭ দিন অতিবাহিত হয়েছে তার। এর মধ্যে তিনি ১১২০ দিনই ক্যাম্পাসে না এসে ঢাকায় ছিলেন। উপাচার্যের দীর্ঘ অনুপস্থিতির প্রতিবাদ জানাতে এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশাল একটি হাজিরা বোর্ড টাঙানো হয়েছিল। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর