‘১৮১ বছর ধরে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে ঢাকা কলেজ, এটি বিরল’
ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ (৭৪তম) অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেছেন, ঢাকা কলেজ ১৮১ বছর ধরে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের আসন ধরে রেখেছে। এটি বিরল ঘটনা। এত সময় ধরে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখাটা অনেক কঠিন।
রোববার (২০ নভেম্বর) বিকেলে ঢাকা কলেজের ১৮১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা পোস্টকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
অধ্যাপক সেলিম বলেন, এই সময়ে ঢাকা শহরের অনেক প্রতিষ্ঠান শীর্ষস্থান থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু ঢাকা কলেজ এখনও শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। দীর্ঘপথচলায় আজ ঢাকা কলেজ ১৮২ বছরে পদার্পন করেছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের এবং আনন্দের। ঢাকা কলেজ এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান যা অসংখ্য কৃতি শিক্ষার্থীর গৌরবে গৌরবান্বিত। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে সব শিক্ষার্থীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। একইসঙ্গে এখানকার শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই যাদের মেধা মননে ঢাকা কলেজ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকা কলেজ এই উপমহাদেশের শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। একইসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বেশি সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভবন, ছাত্র, পাঠাগার ও ২০ হাজার বই বিসর্জন দিয়ে যে অনন্য নজির স্থাপন করেছে তা ইতিহাসে বিরল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ঢাকা কলেজে অনার্স মাস্টার্স কোর্স চালু ছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী নিশ্চিত করার জন্য ঢাকা কলেজে উচ্চশিক্ষা বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে রূপান্তর করা হয়।
বিজ্ঞাপন
এমনকি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট কাটাতে ঢাকা কলেজের শিক্ষকরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও কষ্ট ছিলো বলে জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মূল ফোকাসে চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমনটি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অসামান্য অবদান সেটি ইতিহাসে বড় একটি জায়গা দখল করে আছে। এসব কারণে ঢাকা কলেজ তখন পিছিয়ে পড়েছে। তবে এ দেশের ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদেরও বিশাল অবদান ছিলো। ঢাকা কলেজ অনেক রাজনীতিবিদ, জ্ঞানীগুণী শিক্ষক, গবেষকের জন্ম দিয়েছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই সন্তানও কিন্তু ঢাকা কলেজের গর্বিত শিক্ষার্থী ছিলেন। এর বাইরেও বর্তমানের অনেক উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদ আছেন যাদের রাজনীতিতে হাতেখড়ি এই কলেজে হয়েছে।
আমি নিজেকে অধিক ভাগ্যবান মনে করি এজন্য যে, ঢাকা কলেজে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে পেরেছি। এটি আমার জীবনের চরম পাওয়া। ১৯৯২ সালে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেওয়ার পর অবসর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ঢাকা কলেজে আমি প্রায় ২০ বছর শিক্ষকতা করেছি। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবেও স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করেছি। এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে গিয়েছি।
তিনি বলেন, আমাদের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। কারণ ২০৩০ সালের মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার মূল নিয়ামক হচ্ছে শিক্ষা। একইসঙ্গে সামনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যে ধাক্কা সেটিও আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। সেখানেও শিক্ষা হচ্ছে মূল নিয়ামক।
এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা কলেজসহ ছয়টি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। আমি মনে করি এতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের লক্ষ্য কিছুটা হলেও পূরণ হবে। কিন্তু সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও ভূমিকা পালন করতে হবে।
সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যে সুযোগ সুবিধাগুলো দরকার সেগুলো অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে আমরা দেখেছি, কলেজে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় একেবারেই কম। অথচ তারা একইসঙ্গে চাকরির বাজারে অংশ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাজেট আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলেও মনে করি।
ঢাকা কলেজ নিয়ে বিশেষ কোনো স্মৃতি রোমন্থন করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু প্রায় ২০ বছর ঢাকা কলেজে চাকরি করেছি তাই অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। ভালো-মন্দ অনেক কিছুই আমার স্মৃতিতে আছে। একটা কষ্টের স্মৃতিই বলি। বিষয়টি আমার জন্য অনেক কষ্টের ছিল। ঢাকা কলেজে পদায়ন হওয়ার পর ১৯৯২ সালে ফরহাদ হোসেন নামের ঢাকা কলেজের একজন নিরপরাধ শিক্ষার্থীকে নীলক্ষেতে ব্যবসায়ীরা পিটিয়ে হত্যা করেছিল। যার নামে এখন শহীদ ফরহাদ হোসেন ছাত্রাবাস করা হয়েছে। আসলে সে সম্পূর্ণ নিরপরাধ ছিল।
মূলত আমাদের কিছু ছাত্রের সঙ্গে তাদের (ব্যবসায়ীদের) বচসার জেরে পরে নীলক্ষেতে তাকে ঢাকা কলেজের ছাত্র শুনেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। এটা আমার একেবারেই চাকরির প্রথম দিকের ঘটনা। এসময় আমরা খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম।
তবে ২০১০ সালের একটি ভালো স্মৃতিও স্মরণ করতে পারি। সেটি হলো অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম। তখন অনার্স মাস্টার্সে ভর্তি নিয়ে খুব অনিয়ম হতো। আমরা ২০১০ সালে ঢাকা কলেজ ড. সিরাজ উদ্দিন আহমেদ তখন আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন। কিন্তু সেসব অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। এটা নিয়ে আমাদেরকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমাদের এই অবস্থানের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন নির্দেশ দিয়েছিলেন যে ভর্তি কার্যক্রম বছর অনলাইনে শুরু করার। পরের বছর থেকে পর্যায়ক্রমে উচ্চমাধ্যমিকেও অনলাইনে ভর্তি শুরু হয়। আমি মনে করি ঢাকা কলেজ অবশ্যই এই গৌরবের অংশীদার হতে পারে। আর অনেক বড়মাপের ব্যক্তিদের সঙ্গে চাকরি করার সৌভাগ্য হয়েছে। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে সহকর্মী হিসেবে আমি কাজ করেছি। এরকম অসংখ্য স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে।
সবমিলিয়ে প্রত্যাশা করি আগামী দিনগুলোতেও ঢাকা কলেজ গৌরব ঐতিহ্য ধরে রেখে সফলতার শীর্ষে আরোহন করবে।
আরএইচটি/জেডএস