‘মুই গরিব মানুষ বাহে। আইতোত চ্যাংড়ারা মারামারি করি মোর দোকানের সোগকিছু ভাঙি দিচে। মুই কি করি খাইম, কার কাছে দোকানের জনতে যাইম? আল্লাহ ছাড়া মুই কাক এই বিচার দেইম। দ্যাকো বাহে দোকানটা মোর তছনছ হয়্যা গেইচে।’

এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিলাপ করে বলছিলেন রংপুরের পার্কের মোড় এলাকার ‘ভাই-বোন টি স্টোর’ দোকান মালিকের স্ত্রী হালিমা খাতুন। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, পার্কের মোড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মারামারির সময় কয়েকজন লাঠি নিয়ে এসে দোকান বন্ধ করতে বলে। কিন্তু আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার দোকানের চেয়ার, টেবিল, বিস্কুটের বয়াম, এমনকি ফ্রিজ ও দোকানের পাশে থাকা মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। আমার দোকানের সবকিছু ভেঙে ফেলেছে। আমরা এখন কী করে খাব!

তিনি আরও বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমার অসুস্থ স্বামীকে সঙ্গে নিয়েই দোকানটি চালাই। এই দোকানের আয় দিয়েই আমার পাঁচ সদস্যের পরিবার চালাতে হয়। বাড়িতে বৃদ্ধা শাশুড়ি ও দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনারও খরচ জোগাতে হয়। এছাড়া মাথার উপরে কিস্তি রয়েছে। এ অবস্থায় দোকান খুলে মানুষকে কোথায় বসতে দেব, কীভাবে দোকান চালাব?

হালিমা খাতুন বলেন, আমার দোকান ভাঙচুরে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমি এ লোকসান কীভাবে সামাল দেব? আমি এর ক্ষতিপূরণ চাই।

শুধু হালিমার দোকানই নয় বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-স্থানীয়দের সংঘর্ষের সময় আশপাশের এলাকার আরও বেশ কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করা হয়। এসময় অনেক ক্রেতা বিল না দিয়েই চলে যায় বলে জানা যায়।

হালিমার দোকানের পাশের ‘মা-বাবা টি স্টোর’ এর মালিক আক্তারুজ্জামান বিপুল বলেন, সন্ধ্যার পর দোকান চালাচ্ছিলাম। এ সময় কয়েকজন লাঠি হাতে ছুটে আসে। দোকান বন্ধ করতে না করতেই দোকানের বাইরে রাখা সব টুল ভেঙে দেয়। যারা দোকানে চা-বিস্কুট খাচ্ছিল তারা টাকা না দিয়েই ওই সময় চলে যায়। আমরা গরিব মানুষ। এই দোকান করেই আমাদের খেতে হয়। একইসঙ্গে দুইটা কিস্তিও চালাতে হয়। আমার দোকান ভাঙচুরে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমি এর ক্ষতিপূরণ চাই।

পার্কের মোড় দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, পার্কের মোড় এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে এ এলাকার ১০টিরও অধিক দোকান ভাঙচুর করা হয়। এমনকি দোকানের পাশে থাকা যানবাহনও ভাঙচুর করা হয়। অন্যায়ভাবে চালানো এ হামলার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা দোকান বন্ধ রাখব এবং আইনের আশ্রয় নেব।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পিঠা উৎসবে বান্ধবীকে উত্যক্ত করা নিয়ে স্থানীয় একজনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর কথা কাটাকাটি হয়। এর জের ধরে বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় পার্কের মোড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে স্থানীয়রা আটক করে মারার হুমকি দেয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আটক শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে কথা কাটাকাটি থেকে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষের লোক জড়ো হওয়ায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে।

এসময় স্থানীয়রা সালামের মোড় ও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক ও পার্কের মোড় এলাকায় রণক্ষেত্র ও ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়। উভয়পক্ষ ইটপাটকেল ছুড়ে ও দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মহড়া দেয়। এ সময় পার্কের মোড় এলাকার বেশকিছু দোকান ভাঙচুর করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা ও পুলিশ প্রশাসনের দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। ঘটনা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শিপন তালুকদার/এমজেইউ