ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে এক ব্যক্তিকে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেছেন বিভাগের চেয়ারম্যান ও একজন সিনিয়র অধ্যাপক। সুপারিশকৃত ব্যক্তির বয়স ৬৫ বছর। তিনি গত ২০ বছর ধরে এ বিভাগের শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করে আসছেন।

শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে আবেদনকারীর নাম ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী। তিনি ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের আমির। বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন ও সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক ড. কেএম সাইফুল ইসলাম খান প্রভাব খাটিয়ে তাকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন বিভাগের অন্য শিক্ষকেরা।   

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিভাগের উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির (সিঅ্যান্ডডি) সভার এক ঘণ্টা আগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য বিভাগীয় চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী। চেয়ারম্যান সেটি তখনই সিঅ্যান্ডডি কমিটিতে তোলেন এবং একই দিন ডিন বরাবর সুপারিশ করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি সেটি সই করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির। এখন উপাচার্য অনুমোদন করলেই ঈসা শাহেদী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন।

বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ড. ঈসা শাহেদী গত ২০ বছরে বহুবার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করেন। কম যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ায় প্রতিবারই বাদ পড়েন তিনি। এবার খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগে সিঅ্যান্ডডি কমিটির সদস্যদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তাকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।

ঈসা শাহেদী বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে ১৯৭৩ সালে আলিম ও ১৯৭৫ সালে ফাজিল পাস করেন। ওই সময় মাদ্রাসা বোর্ডের এই দুই সনদ মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পায়নি। পরে শাহেদী ১৯৯৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (পাস) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে যথাক্রমে এমএ প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব উত্তীর্ণ হন।

এর আগে অন্য একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে ঈসা শাহেদী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে আবেদন করেন। তখন বিভাগ থেকে মাদ্রাসা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছালেহ আহমেদের কাছে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ঠিক আছে কি না জানতে চাওয়া হয়।

জবাবে বিভাগীয় চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে মাদ্রাসা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানান, ১৯৭৩ সালে ফাজিল শ্রেণির কোনো মান ছিল না। তখন এসএসসির নিচে আলিম ও ফাজিলের মান ধরা হতো।

উল্লেখ্য, আগে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আলিম ও ফাজিল ডিগ্রিকে ২০০ নম্বরের বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষা প্রদান ও উত্তীর্ণের শর্তে এসএসসি ও এইচএসসি-র মান প্রদান করা হতো। ১৯৭৯ সাল থেকে আলিম এবং ১৯৮১ সাল থেকে ফাজিল সরাসরি এসএসসি ও এইচএসসি-এর মানপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সাল থেকে দাখিল এসএসসি ও ১৯৮৭ সাল থেকে আলিম এইচএসসি-এর সমমান বলে সরকার কর্তৃক স্বীকৃত হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের একাধিক শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে জানান, ইসা শাহেদীর অনার্স নেই, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান কোনো সার্টিফিকেটও নেই। তিনি গত ২০ বছর ধরেই শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাকে নিয়োগ দিতে প্রতিবারই উঠেপড়ে লাগেন অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খান। এবারও তড়িঘড়ি করে একাডেমিক কমিটিতে আলোচনা না করে তাকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।

বিভাগের এক শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দুইজন প্রভাষক নিয়োগের জন্য সিঅ্যান্ডডি কমিটির সভা ডাকা হয়। সে সভার মাত্র এক ঘণ্টা আগে ঈসা শাহেদী খণ্ডকালীন শিক্ষক হতে একটা দরখাস্ত দেন। আমাদের দুইজন শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছেন। এখন খণ্ডকালীন শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। তারপরও শাহেদীকে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে! তার চেয়ে বহুগুণ যোগ্য আমাদের নিজেদের শিক্ষার্থীই রয়েছেন।

এ বিষয়ে সিঅ্যান্ডডি কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা নির্ধারিত কোনো এজেন্ডা ছিল না। এটাকে পকেট এজেন্ডা বলে। হুট করে এনে বিষয়টি পাস করে দেওয়া হয়েছে। আমরা বিরোধিতা করলেও সেটি তোয়াক্কা করা হয়নি।

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম খান তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি (ঈসা শাহেদী) এ বিভাগ থেকে মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন, আমার আন্ডারে তিনি পিএইচডি করেছেন এবং আমাদের এখানে পড়ানোর যোগ্যতা রাখেন। তার সার্টিফিকেটে কোনো সমস্যা থাকলে সেটা আরও আগে ধরা পড়ার কথা। তাছাড়া পার্ট টাইম একটা আলাদা বিষয়, এটা রেগুলার জব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক প্রফেশনাল লোক আছেন যারা পার্টটাইম ক্লাস নেন। তাকে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সুপারিশ করা হয়েছে।

বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মনে করছি, আমাদের শিক্ষক-স্টাফের বাইরে তার কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিতে পারি। একাডেমিক কাউন্সিলে আমাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত আছে যে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ভালো পণ্ডিত লোককে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে লাগানো যায়। আমরা নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটাইনি। তড়িঘড়িরও কিছু নেই। এটা স্থায়ী কোনো পোস্ট নয়। ৬ মাসের জন্য আমরা সুপারিশ করেছি, নিয়োগ দেওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভর করবে।

এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা জানিয়েছেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির।

জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, তার (ইশা শাহেদী) ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে ভালো দখল আছে, যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি। তবে বর্তমানে নিয়মিত ডিগ্রি থাকা আবশ্যক। এ বিষগুলো আমি জানি না, খোঁজ নিয়ে দেখব।

এইচআর/এসকেডি