ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ভবন (ফাইল ছবি)

বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের চার বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। দীর্ঘ ২৮ বছরের অচলাবস্থা ভেঙে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ডাকসু ও হল সংসদের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল।

ওই নির্বাচনে ২৫ পদের ২৩টিতেই জয় পায় ছাত্রলীগ প্যানেলের নেতারা। শুধুমাত্র ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয় পান ছাত্র অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর ও আখতার হোসেন।

সেসময় ডাকসু নির্বাচনকে ক্যালেন্ডার ইভেন্ট হিসেবে চালু রাখার কথা বলা হলেও গত চার বছরে নতুন নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। অথচ এসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন, সিনেট, সিন্ডিকেট, কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতিসহ সকল পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো বারবার ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানালেও ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সর্বমহলের সহযোগিতা’-এর ওপর দায় চাপিয়ে এড়িয়ে যায় ঢাবি প্রশাসন। অথচ ডাকসু নির্বাচন দিতে বাঁধা কোথায়, কেন হচ্ছে না! সে বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্যও দিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাই স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলছেন- ‘ঢাবিতে সব নির্বাচন হয়, ডাকসুতে কেন অনীহা?’

ডাকসু নির্বাচনের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ছাত্রনেতা, প্রশাসনসহ প্রায় সব মহলের সঙ্গে কথা বলে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার কারণ জানার চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্ট।

ডাকসু হলে ঢাবির স্থিতিশীলতা বজায় থাকে
ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষর্থীদের অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করতে ডাকসু নির্বাচনে অনীহা বলে মত তাদের। আর তাই নিয়মিত ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডাকসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সকল দাবি-দাওয়া পূরণের একমাত্র ঠিকানা। শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের সকল যৌক্তিক চাহিদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট উপস্থাপন করে ও তা পূরণে প্রশাসনের ওপর ইতিবাচক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বমূলক এই সংসদটি স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের মূর্ত প্রতীক। আমরা চাই এটি নিয়মিত হোক।

আইন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, নিয়মিত ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিসি মেকিংয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব থাকতো‍। এখন সেটা নেই‍। কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষকসহ সবার প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়‍। কেবল শিক্ষার্থীদের হয় না‍। নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন হলে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে বলে আমি মনে করি।

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডাকসুর অবদান সপ্রতিভ। বাংলাদেশের ইতিহাসের যে অংশটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সগৌরব অবদান আলোচিত হবে- সে অংশটায় নেতৃত্বের জায়গায় আলোচিত হবে মূলত ডাকসুর অবদান। সে অবদান স্বীকার করেলেও ডাকসু নির্বাচন দিতে প্রশাসনের এতো অনীহা কেন? সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষর্থীদের অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করতে প্রশাসনের এই সিস্টেমেটিক দৈনতা ইতিহাসের নিরিখে বুদ্ধিবৃত্তিক ষড়যন্ত্র বলেই বিবেচিত হবে। আর তাই দ্রুত ডাকসু চাই।

নিয়মিত ডাকসু চান ছাত্রনেতারা
ছাত্রনেতারা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের অধিকার, এটিকে তারা ক্যালেন্ডার ইভেন্ট হিসেবে চান। ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবি তাদের। দাবি আদায় না হলে আন্দোলনের ঘোষণাও দিয়েছেন তারা।

ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বিশ্বাস করি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীদের যেসব সমস্যা রয়েছে, আশা-আকাঙ্ক্ষা রয়েছে সেটি পূরণ হবে। আমরা সবসময় ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে। এ বিষয়ে আমরা ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছি, আলোচনা করব এবং আলোচনা যদি সফল না হয় আন্দোলনও করব।

ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিক হলে সকল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সাথে আলোচনা করে ডাকসু নির্বাচন করা সম্ভব। প্রগতিশীল সকল ছাত্রসংগঠনের সহবস্থান নিশ্চিত করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সকল যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করতে চায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।

ঢাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি আসিফ মাহমুদ বলেন, ডাকসু নির্বাচন হলে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে ছাত্র নির্যাতন, দুর্বৃত্তায়নের যে রাজনীতি সেটা থাকে না। একইসঙ্গে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত হয়। সে কারণে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সাথে যোগসাজশ করে নির্বাচন থেকে দূরে থাকছে প্রশাসন। আমরা ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। সামনেও আমাদের কর্মসূচি রয়েছে এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোকেও ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎভাবে কাজ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।

নতুন প্রতিনিধির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চান সাবেকরা
ডাকসুর সাবেকরারা বলছেন, ডাকসু থাকলে শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে প্রশাসনের সাথে দরকষাকষির সুযোগ থাকে। সে সুযোগটি বন্ধ রাখতে এবং একক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতেই ডাকসু নির্বাচন দিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে নতুন নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চান সাবেকরা।

ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে- ২৮ বছর পরে নির্বাচনের ধারাবাহিকতা শুরু হওয়ার পরও আবার সেটি বন্ধ হয়ে গেল। বর্তমান উপাচার্য-প্রক্টরের নেতৃত্বেই গত নির্বাচন হয়েছে; উনাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা চাইলেই আরেকটি সুন্দর ডাকসু নির্বাচন উপহার দিতে পারে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী নয়। ডাকসু থাকলে প্রশাসনিক কাজে ছাত্রদের একটা অংশগ্রহণ থাকে, যেটা হয়ত প্রশাসনে যারা আছেন তারা পছন্দ করছেন না। তবে এখানে যদি ছাত্রদের সক্রিয় ভূমিকা থাকে, বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনগুলো যদি কর্মসূচি দিয়ে চাপ তৈরি করে তাহলে প্রশাসন চাইলেও ডাকসু নির্বাচন বন্ধ রাখতে পারবে না।

দ্রুত ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সর্বশেষ জিএস গোলাম রাব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চাই ডাকসুর যে অচলায়তন ভেঙে আমরা আসছি এই ধারাটা অব্যাহত থাকুক। আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি হবো এবং ডাকসু পাওয়ার জন্য যে সংগ্রামটা আমরা করেছি তার পূর্ণতা পাবে যদি আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারি। যত দ্রুত সম্ভব ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা উচিত।

সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, ডাকসুর গঠনতন্ত্রে বলা আছে- ডাকসুর মেয়াদ হবে এক বছর। যদি এই মেয়াদকালের মধ্যে পরবর্তী ডাকসু নির্বাচন না হয় তবে তিনমাস সময় বৃদ্ধি পাবে। তিনমাসের জায়গায় তিন বছর হলো কিন্তু ডাকসু হবার আর নাম নেই। ডাকসু-ই শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্লাটফর্ম। কিন্তু, নির্বাচন না দিয়ে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের অধিকার বঞ্চিত রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলের নির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু বাদ পড়ছে শুধু শিক্ষার্থীরা। আমরা ডাকসু চাই।

নির্বাচনের পক্ষে ঢাবি শিক্ষক সমিতি
ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতারা। ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতৃত্ব গঠনে এটি জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভুঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নেতৃত্বগুণ বিকশিত হয় যা ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতৃত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা চাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। ছাত্ররা চাইলে আমরা তাদের হয়ে দাবি জানাব।

সমিতির সহ-সভাপতি অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ২০১৯ সালে দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আমরা চেয়েছিলাম পরবর্তী বছরগুলোতে সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা মনে করি ছাত্র নেতৃত্ব ও পরবর্তীতে জাতীয় নেতৃত্ব গঠনে নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন খুবই জরুরি।

ডাকসু না হওয়া প্রশাসনের ব্যর্থতা ও দুঃখজনক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন চলমান না থাকা দুঃখজনক বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের মিলনমেলার অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, ছাত্র সংসদের নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর। মেধাবী ছাত্ররা সেখান থেকে বের হয়ে আসতো, মেধাহীন ছাত্ররা কখনও নির্বাচিত হতে পারতো না। তাদেরকে গান করতে হতো, ডিবেট করতে হতো, নাটক করতে হতো, খেলাধুলা করতে হতো। সেসব চৌকস ছেলেরাই নেতৃত্বে আসতো। সেখান থেকে ভবিষ্যত নেতৃত্ব গঠিত হতো। সে ডাকসু চলমান না থাকাটা দুঃখের বিষয়।

এদিকে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ডাকসু নির্বাচন করতে না পারা প্রশাসনের ব্যর্থতা বলে মনে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ডাকসু নির্বাচন প্রতিবছরই হয়। এটা করতে না পারা প্রশাসনেরই ব্যর্থতা। এতে আওয়ামী লীগের কোনও হস্তক্ষেপ নেই।

যা বলছেন উপাচার্য
সব মহলের আন্তরিক সহযোগিতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির চর্চা শক্তিশালী হলে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে একাধিকবার জানিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।

ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচন হলে ভালো। এটি আমাদের ভাবনার মধ্যে আছে। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও অনূকূল পরিবেশ পেলে নিঃসন্দেহে এটি হওয়া উচিত।

নিয়মিত নির্বাচন দিতে না পারা প্রশাসনের ব্যর্থতা কিনা- জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।

এইচআর/টিএম