চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ফার্সি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের একটি অডিও ফাঁস হয় গত বছরের মার্চে। প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধানে অডিও ফাঁসের চার মাস পর জুলাইয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করে প্রশাসন। কমিটি গঠনের ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও জমা পড়েনি প্রতিবেদন। তাই প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মার্চের শুরুতেই চবির ফারসি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত ফোনালাপের অডিওটি ফাঁস হয়। এ ঘটনা তদন্তে ৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মঈনুল হক মিয়াজীকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এদিকে অডিও ফাঁসের সঙ্গে চবি ভিসি ড. শিরীন আক্তারের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল মোকর রবিনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলে ১৬ মার্চ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। রবিনকে যখন বরখাস্ত করে প্রশাসন তখনও তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেনি।

অবশেষে ড. মঈনুল হক মিয়াজীর নেতৃত্বাধীন কমিটি একই বছরের ৬ জুলাই ৮ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। আবার অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিতও করতে পারেনি কমিটি।

>>> আরও পড়ুন : দিনে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক, রাতে মামলার প্রধান আসামি

তবে সেই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের ৪ নম্বর কলামে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অভিযুক্ত কর্মকর্তা রবিন তদন্ত কমিটির কাছে সদুত্তর ও বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি এবং সত্য প্রকাশ করেননি বা কিছু গোপন করেছেন।’ তথ্য গোপন করাকে ‌‘দায়িত্বে থেকে অসদাচরণ’ আখ্যা দিয়ে তদন্ত কমিটি খালেদ মিছবাহুল মোকর রবিনকে পদাবনতির সুপারিশ করে। 

এদিকে তদন্ত কমিটির সে প্রতিবেদন নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া রবিন। পরে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর দ্বৈত বেঞ্চ রবিনের বহিষ্কারাদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়ে তাকে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের অনুমতি দেন। এরপর তিনি কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন।

>>> আরও পড়ুন : ঘুরেফিরে ‘শূন্যের বৃত্তে’ চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল

গত বছরের ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩৮তম এক্সট্রা অর্ডিনারি সিন্ডিকেট সভায় অধিকতর তদন্তের জন্য সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌলাকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি গঠনের ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চূড়ান্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জানান, কোনো অপরাধে জড়িতদের শনাক্ত করে বিচার নিশ্চিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রশাসন। এক্ষেত্রে অবশ্যই অপরাধের সঙ্গে অপরাধী কিভাবে জড়িত এবং কীভাবে অপরাধটি সংগঠিত হয়েছে এসব বিষয় বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দিতে হয়। এছাড়াও অভিযোগকারী ও তার স্বপক্ষে যথার্থ সাক্ষ্যপ্রমাণও প্রয়োজন। একটি ফোনালাপ দিয়ে কাউকে বিচারের আওতায় আনার আইনগত সুযোগ নেই। এই ফোনালাপে কারা টাকা দিতে চেয়েছেন, কে টাকা নিতে চেয়েছেন এবং কার জন্য নিতে চেয়েছেন? নাকি অভিযোগকারীরা কাউকে উল্টো ফাঁসানোর জন্য করেছেন, সেটি তদন্ত করে আদ্যোপান্ত বের করে আনতে হয়। যদিও ওই ঘটনায় গঠিত অধিকতর তদন্ত কমিটি ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রতিবেদন দেয়নি।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্তের কাজ শেষ পর্যায়ে। নির্দিষ্ট তারিখ বলা যাবে না, তবে শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

>>> আরও পড়ুন : রোগীর স্বজন পিটিয়ে ‘পলাতক’ পাঁচলাইশ থানার ওসি-এসআই

তদন্তে কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে, তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অভিযুক্ত খালেদ মিছবাহুল মোকর রবিন বলেন, আমি মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়েছি। মোট ১১১ দিন তদন্ত করে প্রথম তদন্ত কমিটি ৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের কোথাও তারা আমার বিরুদ্ধে অনৈতিক ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যের প্রমাণ সম্বলিত কোনো তথ্য উল্লেখ করেনি।

গত বছরের ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩৮তম এক্সট্রা অর্ডিনারি সিন্ডিকেট সভায় অধিকতর তদন্তের জন্য সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌলাকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি গঠনের ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।

তদন্ত কমিটি বলেছে, আমি তথ্য গোপন করে অসদাচরণ করেছি। তারা তদন্তে দেখাতে পারেনি, আমি কি তথ্য গোপন করেছি, যা অসদাচরণের শামিল হয়। তারপরও কোনো অজানা কারণে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আমাকে শাস্তির সুপারিশ করে কমিটি। অবাক হওয়ার বিষয়, যারাই আমার বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেছেন, তারাই এই রিপোর্টের বৈধতা দিয়ে আমাকে শাস্তির সুপারিশ করেছেন। যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪তম সিনেট সভায় একজন সদস্য প্রশ্ন উত্থাপন করলে সিনেট সভাপতি ও সচিব কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এসব বিষয় উল্লেখ করে আমি উচ্চ আদালতে শরণাপন্ন হওয়ার পর আদালত আমাকে চাকরিতে যোগদানের অনুমতি দেন।

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার বলেন, অধিকতর তদন্ত রিপোর্ট পেলেই দায়ীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সঙ্গে সঙ্গে সাময়িক বহিষ্কার করেছিলাম। হাইকোর্ট থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের উপর স্থগিতাদেশ এনে কাজে যোগ দিয়েছেন। তবে অধিকতর তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি দ্রুত রিপোর্ট দিলেই তা সিন্ডিকেটে উত্থাপিত হবে। সিন্ডিকেটই শাস্তি নির্ধারণ করবে।

এমআর/এসকেডি