তাসনুবা মেহেরীন স্বর্ণা ও তাসনিম বসুসিয়া

আজ বিশ্ব মা দিবস। মা, জননী, গর্ভধারিণী। জন্মের আগে থেকেই যার সঙ্গে দৈহিক ও আত্মার বন্ধন। সেই জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানাতে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবসটি পালন করা হয়।

ছোটবেলা থেকে আদর, যত্ন আর ভালোবাসায় সন্তানকে বড় করে তোলেন একজন মা। নিজের জীবনের সবটা দিয়ে আগলে রাখেন পরম মমতায়। বন্ধু, স্বজন, ক্যারিয়ার সবকিছুই ঠুনকো হয়ে যায় সন্তানের কাছে।

সময়টা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হয় যখন শিক্ষার্থী অবস্থায় মাতৃত্বের প্রথম অনুভূতি আসে। একইসঙ্গে পড়াশোনা, সন্তান, সংসার সামলে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলেন তারা। শিক্ষার্থী অবস্থায় মাতৃত্বের মধুর অনুভূতি নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষার্থী। তাদের মতামত তুলে ধরেছেন ঢাকা পোস্টের বাকৃবি প্রতিনিধি মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর।

ছেলেকে নিজের জন্য সৌভাগ্য স্বরূপ উল্লেখ করে বাকৃবির পশুপালন অনুষদের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তাসনুবা মেহেরীন স্বর্ণা বলেন, ২০২১ সালে আমি যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী, তখন আমার ছেলে সন্তান হয়। আত্মীয়স্বজন সবার একটাই কথা ছিল, এইতো পড়াশোনা শেষ, ক্যারিয়ার শেষ। সবার কথা শুনে একটা সময় ভেঙে পড়েছিলাম, তবুও মনকে সান্ত্বনা দিতাম এই ভেবে যে, সৃষ্টিকর্তা ভালো ভেবেই‌ হয়ত দিয়েছেন। কর্মজীবী মায়েরা সন্তান-সংসার দুটোই সামলাতে পারলে আমিও পারব। এরপর থেকেই শুরু হলো আমার নতুন‌ জীবন। প্রতিটি দিন পার হয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে। শান্তির হল লাইফ ছেড়ে ভাড়া বাসায় চলে আসলাম। রাত জেগে বাবুকে সামলানো, সে ঘুমালে নিজের পড়াশোনা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্র্যাকটিক্যাল লেখা শেষ করে আবার সকালে ৮‌টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস করা। দুই ক্লাসের মাঝে সামান্য সময় পেলে বাসায় এসে বাবুকে সময় দেওয়া। তারপর আবার ক্লাসে ফিরে আসা। এটাই ছিল আমার রুটিন।

তিনি আরও বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, ট্যুরে যাওয়া সব বাদ হয়ে গিয়েছিল। সবার আনন্দ দেখে অনেক মন খারাপও হয়েছে, তবুও দিনশেষে ছেলের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গিয়েছি। আর সবকিছুর মাঝে আমার আম্মু আর স্বামীকে পাশে পেয়েছি। আসলে আম্মু পাশে না থাকলে হয়ত এটা সম্ভব হত না। মা হওয়ার অনুভূতি সত্যিই‌ অন্যরকম। পৃথিবীর সব সুখ তখন একজনের মুখের হাসিতেই। সত্যিই আমার ছেলে আমার জন্য সৌভাগ্য স্বরূপ। সে আসার পর আমার জীবনের সব ভালো কিছু হয়েছে, আল্লাহর রহমতে আমার রেজাল্টও আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো ছেলেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। আর নিজের পড়াশোনা শেষ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। মহান আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া যেন‌ আমি আমার ছেলেকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে পারি।

বাচ্চার ‘মা’ ডাকে সকল প্রশান্তি খুঁজে পান বাকৃবির মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাসনিম বসুসিয়া। তিনি বলেন, মা কথাটির মানে খুব ভালোভাবে বুঝেছি যখন নিজে মা হয়েছি। প্রতিদিন নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছি। একজন ভালো মা হওয়াটা ভীষণ কঠিন আর শিক্ষার্থী অবস্থায় মা হলে তা বেড়ে যায় আরও কয়েকগুণ। পড়াশোনা আর স্বামীর চাকরির সুবাদে বিয়ের পর থেকেই বাইরে থাকা হয়। এজন্য মা হওয়ার আগে ও পরের সব পরিস্থিতি আমাকে একা সামলাতে হয়েছে। এক্ষেত্রে পরিবার থেকে দূরে থাকার জন্য অনেক বেশিই পরিশ্রম হয়েছে। মা হওয়ার পর শিখেছি এক ঘণ্টার কাজ কীভাবে পাঁচ মিনিটে করতে হয়। একটা কথা প্রচলিত আছে যে, মায়েদের কখনো ছুটি নেই। বিরামহীন দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। এত কিছু সামলে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন। তবে সুশিক্ষিত হওয়ার ইচ্ছা আমাকে শক্তি জোগায়। এজন্য যতটুকু সময় পাই নিজের পড়াশোনা করি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসি। যতক্ষণ না বাচ্চা উঠে পড়ে তার আগেই পড়া শেষ করার চেষ্টা করি। কখনো বাচ্চা ঘুমিয়ে গেলে রাত জেগে পড়াশোনা করি। আবার কখনো ক্লাসের ফাঁকে লাইব্রেরিতে গিয়ে চেষ্টা করি পড়াটা এগিয়ে নেওয়ার।

তিনি আরও বলেন, সংসার, বাচ্চা, ক্লাস, প্র্যাকটিক্যাল সব সামলিয়ে যখন অবসর মেলে তখন শরীরে ভর করে একরাশ ক্লান্তি। তবে বাসায় ফিরে বাচ্চার মা ডাক সকল ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। মা বলে জড়িয়ে ধরলে সকল ক্লান্তি, বিষণ্নতা সব হারিয়ে যায় নিমিষে। দেখতে দেখতে তৃতীয় বর্ষ শুরু করতে যাচ্ছি। বাচ্চাটাও বড় হচ্ছে। আশা করি সামনের দিনগুলোতে সংগ্রাম কমে আসবে। আমি পূর্ণ উদ্যমে পড়াশোনায় মন দেব। খুঁজে নেব সফলতার পথ। পরিশেষে এইটুকু বলতে চাই সংসার, বাচ্চা ও পড়াশোনা একসঙ্গে সামলানো অসম্ভব নয় তবে কঠিন। এই কঠিন পথটা পাড়ি দেওয়ার জন্য পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক সবার সহযোগিতার দরকার হয়। সবার সহযোগিতা আর নিজের চেষ্টা থাকলে শিক্ষার্থী মায়েদের চলার পথটা মসৃণ হয়।

মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর/এমজেইউ