‘আমাদের ঘরে খাবার না থাকলেও মা কোথা থেকে যেনো খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলতেন। নিজে না খেয়েও হাসিমুখে আমাদের খাবার দিতেন। প্রতিদিনই দেখতাম আমাদের ভাই-বোনদের খাওয়ানোর সময় তিনি খেতেন না। কখন যে খেতেন আমরা জানতাম না। একদিন খাওয়ার সময় মাকে জিজ্ঞেসা করলাম মা তুমি খাবা না? মা বললো, হাঁড়িতে ভাত আছে পরে খাবো। হঠাৎ একটি বিড়াল এসে হাঁড়িটা নিচে ফেলে দেয় তখন দেখি হাঁড়িতে কোনো ভাত নেই। সবটুকু ভাত আমাদের খেতে দিয়েছেন। তখন বুঝলাম মা মাঝে মধ্যেই না খেয়ে আমাদের ভাই-বোনদের ভাত খাওয়াতেন।’

কথাগুলো বলছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মনিরুল ইসলাম মুকুল।

মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, আমার দাদার অনেক জমি ছিলো কুড়িগ্রামে। নদী ভাঙ্গনের ফলে পুরো পরিবার নিয়ে আমার বাবা চলে আসে ঠাকুরগাঁওয়ে। অনেকটা শূন্য হাতে পরিবারের হাল ধরেন তিনি। আমার দশ ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। অভাবের কারণে কোনো ভাইবোন লেখাপড়া করতে পারেনি। সবাই এখন নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

তিনি বলেন, আমি যখন বুঝতে শিখি তখন দেখি আমার মা টাকার জন্য মানুষের বাড়িতে  কাঁথা সেলাই করতেন। মার হাতের আঙুলের সুঁই এর দাগগুলো এখনো মেশেনি। আমি জানতাম আমার মায়ের কাছে তেমন কিছু নেই। একদিন মাকে এমনিতেই বললাম, মা ভাইদের তো অনেক কিছুই দিলা, আমাকে কিছু দিবা না? মা বললো, তোক দোয়া দিছি। ওদের চেয়েও একদিন তুই অনেক বড় হবি!

এরপর মায়ের দোয়া নিয়েই আমার পথচলা শুরু। পড়ালেখার পাশাপাশি জমি বর্গা নিয়ে কাজ করেছি, মানুষের জমিতে কাজ করেছি, ট্রাক্টর চালকের সহকারি হিসেবেও কাজ করেছি। এভাবে কাজ করার পর যা টাকা পেতাম তা দিয়েই লেখাপড়া চালাচ্ছিলাম। এভাবে এসএসসি, এইচএসসি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সময় যখন একসঙ্গে অনেকগুলো টাকার দরকার হয়, তখন মা তার ২৩টি হাঁস বিক্রি করে দেন। হাঁস বিক্রির টাকা দিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি। আর এখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছি।

মনিরুল ইসলাম বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখিও করছি। ইতোমধ্যে কাব্য 'শান্ত মেঘে লুকিয়ে তুই' (২০২০), উপন্যাসিকা 'মৃত্যুর পাণ্ডুলিপি'(২০২১), গল্পগ্রন্থ 'শয়তান গ্রহ'(২০২১)  প্রকাশিত হয়েছে এবং এখনো লিখছি। আমার হাতের লেখা বই মায়ের হাত দিয়েই মোড়ক উন্মোচন করেছি। যখন মায়ের হাতে আমার লেখা প্রথম বই তুলে দেই তিনি কিছু না বুঝলেও ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তুই অনেক বড় হবি। আমার লেখা কোনো বই বা আমাকে নিয়ে কোনো লেখা পত্রিকায় বের হলে তা মাকে দিলে মা তা উল্টিয়ে দেখে আর ভাঁজ করে ট্রাংকে যত্ন করে রেখে দেন। আমাদের বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে মা তাদের বই আর পত্রিকার অংশ দেখান।

তিনি বলেন, মায়ের কাছে কোনো টাকা পয়সা থাকতো না। একদিন বাড়ি থেকে আসার সময় মা আঁচলের ভাজ থেকে তিনটি ২০ টাকার নোট তুলে দেন আমার হাতে। হয়তো তিনটি ২০ টাকার নোট তেমন কিছু না। তবুও আমার কাছে এগুলোর মূল্য অনেক। আগে দেখতাম মা মাছ-মাংসের চেয়ে দুধ অনেক পছন্দ করতেন কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় মাঝেমাঝে একদিন দুধ কিনে খেতেন। এখন মায়ের জন্য অতিরিক্ত একটা টিউশনি করাই। এর পুরো টাকা মাকে দুধ কিনে খাওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেই। আমার ইচ্ছা আমি চাকরি জীবনে প্রবেশ করলে প্রথম বেতন থেকে মায়ের জন্য একজোড়া সোনার বালা ও মাকে সেই ২৩টি হাঁস কিনে দিবো।

শিপন তালুকদার/এবিএস